দুই বাসের প্রতিযোগিতার মাঝে চাপা খেয়ে হাসপাতালে ট্রাফিক সদস্য



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

দায়িত্ব পালনের সময় তুরাগ পরিবহনের দুটি বাসের প্রতিযোগিতার মাঝখানে চাপা খেয়ে আহত হয়েছেন ট্রাফিক ওয়ারী বিভাগের কনস্টেবল মিথুন। এ ঘটনায় বাস দুটিকে আটক করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) দুপুরে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা মোড়ে দায়িত্ব পালনের সময় এ ঘটনা ঘটে। বিষয়টি নিশ্চিত করেন ওয়ারী বিভাগের ডিসি আশরাফ ইমাম।

তিনি বলেন, দুটি তুরাগ বাসের মাঝখানে চাপা পড়ে কনস্টেবল মিথুনের নাক-মুখ দিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করে। তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সিটি স্ক্যানের পর বোঝা যাবে আঘাত কতখানি।

বাস দুটিকে আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

   

দৃষ্টিহীন মায়ের আশার আলো শাহজাহান



রেদ্ওয়ান আহমদ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম
ছবি: বার্তা ২৪

ছবি: বার্তা ২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

শাহজাহানের বয়স মাত্র ১২ বছর। এই বারো বছর বয়সেই সে যেন এক জীবনযোদ্ধা। ছয় বছর বয়সেই জন্মান্ধ মাকে ফেলে গেছেন রাঙামাটির লংগদুর বাসিন্দা বাবা আলতাফ হোসেন। বড় ভাইটাও মেপেছেন নিজের পথ। এরপর জীবিকার তাগিদে লংগদু ছেড়ে পাহাড়তলীতে এসে মা-সহ ঠাই নেয় সে। মা শুরু করেন ভিক্ষাবৃত্তি আর শাহজাহান জড়ায় শিশুশ্রমে। এভাবেই জন্মান্ধ মাকে নিয়ে গড়ে উঠে তার কষ্টের সংসার। যার কারণে দুয়েকবার স্কুলের বারান্দায় পা রাখলেও ভালো করে স্বরবর্ণের পাঠটাও নিতে পারলো না দারিদ্রের কারণে।

শাহজাহান এখন চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী নতুন ব্রিজ এলাকার একটি দোকানে চার হাজার টাকা মাসে কাজ করে। তাই মাকে আর ভিক্ষাবৃত্তি করতে দেয় না। তবুও জীবনের প্রয়োজনে মাঝে মাঝেই মা সাজেদা খাতুনকে যেতে হয় ভিক্ষা করতে। কিন্তু শাহজাহান মায়ের এই ভিক্ষাবৃত্তি দেখতে চান না। কিন্তু নিয়তি যে তার সহায় নেই!

মায়ের প্রতিবন্ধিতার কারণে ছেড়ে যাওয়া বাবার প্রতি শাহজাহানের অভিমান বিশাল। তাইতো, জীবিত বাবাকে সে পরিচয় করিয়ে দেয় ’মৃত’ বলে। দিবেই বা না কেনো? যে বাবা স্ত্রী সন্তানকে ছেড়ে যেতে পারেন সে বাবা জীবিত থেকেও বা কী লাভ! পড়ালেখা করে অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও এখনো পর্যন্ত শাহজাহানের সে স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেছে। তার যে ঘরে আয়-রোজগারের কেউ নাই!

’আব্বা মারা গেছে অনেক বছর আগে। আমার তখন ছয় বছর। এরপর থেকেই মাকে নিয়ে আমি এখানে থাকি। পড়ালেখা করার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু দুয়েকবার স্কুলে গেলেও আর যাওয়া হয় নাই। দোকানে কাজ করে চার হাজার টাকা মাসে পাই, এইটা দিয়ে মারে নিয়ে কোনরকম চলি।’ অন্ধ মায়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব কাঁধে মাত্র বারো বছরেই এ যেনো এক পঁচিশোর্ধ্ব যুবকের কণ্ঠস্বর।

তখনও মায়ের ভিক্ষাবৃত্তির কথা গোপন করে লাজুক শাহজাহান। মা সাজেদার নাম্বার চাইতেই দেয় সে। বলে, ’মা চোখে দেখে না। তবে, বাটন ফোন দিয়ে কল রিসিভ করতে জানে। আমার মুবাইল নাই। প্রয়োজনে মালিকের মুবাইল দিয়ে ফোন করি।’ অতঃপর জন্মান্ধ মা সাজেদাকে ফোনকল করলে রিসিভ করে তিনি মুঠোফোনটি তুলে দেন প্রতিবেশী রাশেদা বেগমের হাতে।

তার কাছ থেকে সকল তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত হওয়া গেলেও শাহজাহানের বাবার মৃত্যুর বিষয়টা খোলাসা করে তিনি বলেন, ’ওর বাবা মারা যায়নি। ওর মা অন্ধ হওয়ায় একটা সময় পর ওর মা ওদেরকে ছেড়ে চলে যায়। ওদের আর কোন খোঁজ খবর রাখে না। যার কারণে, শাহজাহান বাবা মারা গেছে বলে পরিচয় দেয়। শাহজাহান দোকানে কাজ করলেও এই টাকা দিয়া তাদের সংসার চলে না। যার কারণে সাজেদা মাঝেমধ্যে ভিক্ষা করতে যায়।’

চট্টগ্রামের নতুন ব্রিজস্থ ’সফওয়ান ফুডস এন্ড বিরিয়ানি হাউজ’ এর মালিক নুরুল কবিরের সাথে আমাদের কথা হয়। তিনি বলেন, ’শাহজাহান পড়তে চাইলে পড়বে। বাঁধা নেই। তবে, তার জীবন পরিচালনার জন্য আর্থিক আয়-রোজগারও দরকার। তার পারিবারিক অবস্থা খুবই করুণ। তার মা আছে। তাকে তারই চালাতে হয়। তাই, লোক না লাগা সত্ত্বেও তাকে আমরা দোকানে নিয়েছি। মাসে সাড়ে চার হাজার টাকা বেতনে। সে বাসা থেকে ভাত আনা-নেওয়া করে। দোকানের মালামাল এগিয়ে দেয়। তিন-চার মাস ধরে সে কাজ করছে। ছেলে হিসেবে এ পর্যন্ত তাকে বেশ ভালোই মনে হয়েছে আমাদের।’

শাহজাহানের জন্মান্ধ মা সাজেদা খাতুন কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আল্লাহর কাছে লাখো-কোটিগুণ শুকরিয়া। আমার জীবন এখন এই ছেলেকে নিয়েই। স্বামী গেলো, বড় ছেলে গেলো। এই ছেলে আমাকে আগলে রাখছে। আমাকে ভিক্ষা করতে দিতে চায় না। আমারও ভিক্ষা করতে মন চায় না। কিন্তু কী করবো বলেন, জীবন তো চালানো লাগবো! আমার ছেলেরে নিয়া আমার অনেক স্বপ্ন। সে অনেক বড় হবে একদিন ইনশাআল্লাহ।’

;

ফেনীর ট্রাংক রোড; যেখানে ভোরবেলা চলে শ্রমিক বিকিকিনি



মোস্তাফিজ মুরাদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম,ফেনী
ছবি: বার্তা ২৪

ছবি: বার্তা ২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

দেশব্যাপী চলছে তীব্র তাপদাহ। এর মধ্যে কাক ডাকা ভোরে বাঁশের ঝাকা আর কোঁদাল হাতে ফেনীর ট্রাংক রোডে শ্রম বিক্রির হাটে হাজির দেশের দূর-দূরান্তের প্রায় ৭ শতাধিক খেটে খাওয়া মানুষ। কাজের আশায় শ্রম বিক্রি করতে এ বাজারে ওঠেন তারা। তীব্র গরমে যখন মানুষের হাসফাঁস অবস্থা ঠিক ওই সময় ক্ষুধা আর দারিদ্রের কষাঘাতে নিম্ন আয়ের মানুষগুলো দুবেলা দু’ মুঠো অন্নের জন্য শ্রমিক হিসেবে নিজেকে বিক্রি করেন ফেনীর এই শ্রম বিক্রির হাটে।

প্রত্যেকদিন ভোরে রাজমিস্ত্রী, কাঠমিস্ত্রী, রংমিস্ত্রী ও দিনমজুরসহ বিভিন্ন পেশার শ্রমজীবী মানুষের সরগম হয়ে ওঠে এ হাট। শ্রমিক কিনতে আসেন অনেক প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদার ও মালিকরা। শ্রমের হাটে আসা অনেকে বিক্রি হলেও কিছু থেকে যান অবিক্রিত। দামদর শেষে যারা বিক্রি হন তারা রওনা হন মালিকের গন্তব্যে। অবিক্রিতদের দিনব্যাপী কাটাতে হয় অলস সময়। কাজ না পেলে নিজের গন্তব্যে ফিরে যান তারা।

জানা গেছে, প্রায় তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে ফেনী শহরের জিরো পয়েন্টে, বরিশাল, রংপুর,কুড়িগ্রাম, রামগতি, লক্ষীপুর, নেত্রকোনা, খুলনা, বাগেরহাট, সিলেট, ময়মংসিংসহ নানান জেলার শ্রমজীবী মানুষ আসে এ শ্রম হাটে। নিয়মিত হাট বসলেও এ হাটে নেই কোনো খাজনা বা হাট কমিটির ঝামেলা। আপন গতিতেই চলছে এই হাট, এদিক থেকে কিছুটা শান্তিতে থাকলেও কাজের নিশ্চয়তা ও জীবনের নিরাপত্তা একদম অনিশ্চিত।

শ্রমজীবীরা জানান, মাঝে মাঝে কাজ পেলেও বেশির ভাগ সময় নিজেকে বিক্রি করতে পারেন না। কাজভেদে ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা মজুরিতে জেলার বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে যান তারা। কাজ না পেলে পরিবার নিয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হয় তাদের। রোদ, বৃষ্টি কিংবা ঝড় সবসময় এ হাটে বিক্রির আশায় উপস্থিত হন বলে জানান তারা।

দ্রব্যমূল্যর ঊর্ধ্বগতির বর্তমান বাজারে শ্রমের পর্যাপ্ত মূল্যে পাওয়া যায়না উল্লেখ করে তারা বলেন, সবকিছুর যে দাম। যত টাকা পাই তা দিয়ে একদিন চলাও কষ্টের। দূর থেকে আসি স্টেশন কিংবা ফুটপাতে রাত কাটাই। সকালে কাজ পেলে সন্ধায় আবার কোথাও মাথা গোজার ঠাঁই খুঁজি। এরমধ্যে তীব্র গরমে কাজ করতে হয়, আমাদের দুঃখ দুর্দশা দেখার যেন কেউ নেই।


বরিশালের আবু মিয়া। বিগত ১০ বছর ধরে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন ফেনীতে। আগে সারাদিনের জন্য নিজেকে ৪০০-৫০০ টাকায় বিক্রি করতেন যেকোনো কাজের জন্য। তবে এখন তা বেড়ে ৭০০-৮০০ টাকা হলেও বাজারদর অনুযায়ী চলতে কষ্ট হয় বল জানান তিনি। তিনি বলেন, কাজ পেলে মুখে হাসি ফুটে আমাদের, না পেলে মলিন মুখে পরদিনের জন্য অপেক্ষা করি। তবে ফেনীর মানুষ ভালো, পেট ভরে খাবার দেয়, আবার কাজ শেষে বকশিস দেয়।

লক্ষীপুরের নূরে আলম। যিনি নদী ভাঙ্গনে সব হারিয়ে ফেনীতে দিনমজুরের কাজ করতে আসেন। নিজের দুঃখের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতিদিন সকালে বাজারে উঠে বিক্রি হই। ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা বিনিময়ে আমরা কাজে যাই। বৃষ্টি হলে আবার কাজ নেই তখন কপালে ভাত জোটেনা। কেউ আমাদের কাজে নিলে গৃহস্থ ভালো হলে একটু আপ্যায়ন পাই। আর খারাপ হলে আমাদের উপর নির্মম কাজের অত্যাচার চলে।

তিনি বলেন, কেউ ৩ বেলার খাবার এক বেলায় দেয় অনেকে আবার দেয় না। যে টাকা পাই সেটা দিয়ে খেলে আর কিছুই বাকি থাকেনা। কষ্ট করে চলতে হয় আমাদের। আমরা গরীব মানুষ, আমাদের কথার গুরুত্ব নেই। পেটের দায়ে নিজের শ্রম বিক্রি করে খেতে নিজ জেলা থেকে এখানে এসেছি।

সিলেটের মোবারক আলীর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ফেনীর এ হাটে ভালো কাজ পাওয়া যায়। যার জন্য বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ আসে কাজের খোঁজে। আমরা এখানে কৃষিকাজ, রাজমিস্ত্রীর কাজ করি। ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার বিনিময়ে কাজ করি। এ টাকা দিয়ে সংসার চালানো যায়না। যে শ্রম দিই সে অনুযায়ী টাকা পাইনা। কর্ম করায় আমাদের দিয়ে কিন্তু সে অনুপাতে টাকা দেয় না। আমাদের এসব বিষয়ে যদি সবাই খেয়াল রাখে আমরা আরও বেশি ভালো থাকতে পারব।

চাঁদপুরের আবুল হোসেন বলেন, ফেনীতে কাজ ভালো পাওয়া যায় বিধায় আমরা ফেনীতে আসি। টাকা খারাপ পাইনা তবে কাজের তুলনায় তা অনেক কম।আমরা পারিশ্রমিক অনুযায়ী আরও বেশি টাকা পেতে পারি। তারপরও পরিবারের জন্য কাজ করতে হয়। যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালাই। সরকার যদি আমাদের জন্য কিছু সহযোগীতা করে আমরা আরও ভালো থাকতে পারব।

হাটে শ্রমিক নিতে আসা ফেনীর মো. হানিফ জানান, এখানে আসা শ্রমিকরা খুব ভালো । কথাও শুনে তারা। বাড়ির কাজের জন্য তিন জন শ্রমিক নিয়ে যাচ্ছি। তবে আগের তুলনায় কিছুটা দাম বেড়েছে। শ্রমিকদের প্রশংসা করে তিনি বলেন, মানুষগুলো বেশ কাজের। তাদের কাজের বরকত বেশি। ফেনীতে তাদের বেশ সুনাম রয়েছে।

রফিকুল হায়দার নামে এক ঠিকাদার বলেন, ঠিকাদারি কাজ করি। লোক প্রয়োজন হয়। ফেনীর এ হাটে এসে লোক নিয়ে যাই। আগে ৬০০ টাকা দিয়ে নিয়ে লোক পাওয়া যেত। এখন ১ হাজার টাকার নিচে পাওয়া যায়না। মাটি কাটার জন্য আরও বেশি চায়। গরমের কারণে লোকবলের সংকট পাশাপাশি ধান কাটার মৌসুম হওয়াতে পর্যাপ্ত লোক নেই। ফলে দিনমজুরদের বাড়তি টাকার নিতে হচ্ছে। এদের বেশিরভাগ বাইরের জেলা থেকে আসে। ফেনীর লোকরা গ্রাম অঞ্চলে কাজ করে। টাউনে যারা থাকে সবাই বাইরের।

তবে এসকল শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি দেয়াসহ এ রোদের মৌসুমে রোদে বেশিক্ষণ কাজ না করানোর জন্য মালিকদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন ফেনীর সচেতন মানুষরা।

নূর করিম মুন্না নামে ফেনীর এক সংগঠক বলেন, রোজ সকালে এ মানুষগুলোকে ট্রাংক রোড় এ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। রোদ কিংবা বৃষ্টি অথবা তীব্র শীত। কাজের জন্য তারা সবসময় এখানে আসেন। তাদের শ্রমের যোগ্য মূল্যায়ন হওয়া উচিত। প্রশাসন কিংবা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের উচিত তাদের খোঁজ নেয়া, তাদের শ্রমের সঠিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা। এ যে এখন তীব্র তাপদাহ এর মধ্যে তাদের হিট স্ট্রোকের সম্ভাবনা রয়েছে। শ্রমিক দিবসের আন্দোলন শ্রমিক ন্যায্য অধিকারের আদায়ের জন্য। এসব বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকা উচিত।

মঞ্জিলা মিমি নামে ফেনীর আরেকজন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠক বলেন, শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে সবার ভূমিকা রাখতে হবে। শুধুমাত্র দিনমজুর নয়, ফেনীতে অনেক শ্রমিক আছে যারা অনেক কষ্টে দিন যাপন করে। শ্রমিক দিবসে দায়িত্বশীলদের তাদের বিষয়ে আরও যত্নবান হতে হবে তবেই শ্রম যোগ্য মূল্যায়ন পাবে।

;

নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নেই মাসুদদের, নেই পর্যাপ্ত মজুরিও, শ্রম আইন স্রেফ ‘কাজির গরু’



জাহিদ রাকিব, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা ২৪

ছবি: বার্তা ২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় লন্ড্রি দোকানে কাজ করেন সিরাজগঞ্জের মাসুদ রহমান। এই দোকানে তার কর্মজীবন দীর্ঘ ১৬ বছরের। মালিকের বেশ আস্থাভাজন হয়ে উঠেছেন। কাজ শুরু হয় সকাল ৮ টায়। চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। মাঝখানে গোসলের আর দুপুরের খাবারের জন্য বিরতি পান ঘণ্টা খানেক। মাঝে মধ্যে লোডশেডিং হলে বন্ধ থাকে হাতের কাজ। এটুকুই যা ফুসরৎ।

তিন হাজার টাকার বেতনে চাকরি শুরু হলেও এখন বেতন পাচ্ছেন সাড়ে চৌদ্দ হাজার টাকা। থাকা খাওয়া এই দোকানেই। পরিবারে রয়েছে স্ত্রী ও এক সন্তান। থাকেন গ্রামের বাড়িতে।

মাসুদ রহমান বার্তা২৪.কমকে জানান, অভাবের সংসারে পড়ালেখা করা হয়নি। ছোট বেলায় বাবা মা মারা যান। ছোট ভাই বোনের দায়িত্ব নিতে ছোট বেলা ছুটে আসনের রাজধানীতে। এক আত্নীয়ের মাধ্যমে লন্ড্রির দোকানে চাকরি নেন। প্রথম অবস্থায় কাপড় পরিষ্কারের কাজ করলেও পরবর্তীতে আয়রন করাটাও রপ্ত করে নেন। আর কোনো কাজ শেখা হয়নি। ফলে ১৬ বছর ধরে দিনে ১৬ ঘণ্টা করে ভারী আয়রনে কাপড় ঘষার মাঝেই বন্দি জীবন।

অথচ শ্রম ও সময়ের তুলনায় মজুরি যৎসামান্য। মেলেনা প্রাপ্য পারিশ্রমিক। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চলছে টানাটানির সংসার। এই করেই এক বোনকে সামান্য পড়াশোনা শেখাতে পেরেছেন। ছোট ভাইকে দাদনের মাধ্যমে লোন নিয়ে বিদেশে পাঠিয়েছেন। বোনের বিয়ে দিয়েছেন, নিজেও পেতেছেন সংসার। হয়েছেন কন্যা সন্তানের জনক। তবে সন্তানের পিতৃত্ব উপভোগ করাক সুযোগটাই মেলে না।

মাসুদ বলেন, “পরিবারকে ঠিক মত সময় দেওয়া হয়না। কারণ সপ্তাহে সাতদিনই কাজ। দিনের বেশির ভাগ সময় কাজ থাকায় ফোনে কথা বলতে চাইলেও কথা বলতে পারিনা। তিন চার মাস পর চার-পাঁচ দিনের ছুটিতে যাই গ্রামের বাড়িতে, এই যা!”


দেশে কলকারখানাগুলোতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শ্রম আইন মানা হলে পাড়া মহল্লার দোকান পাটে গড়ে তোলা ছোট খাটো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মানা হয়না মোটেই। ফলে অবহেলিত এই খাতের শ্রমিক শ্রেণি। প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই নেই নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা। এসব দোকানে ঢোকার নির্দিষ্ট সময় থাকলেও বের হওয়ার নির্দিষ্ট কোন কোন সময় নেই।

লন্ড্রি দোকানের মাসুদের মত একই অবস্থা রাজধানীতে বিভিন্ন মুদি দোকান, ফার্মেসি, পাড়ার হোটেল , বাসার দারোয়ানদের। এই তালিকায় রয়েছে আরেক শ্রেণির শ্রমজীবি। তারা গৃহস্থলীর কাজে নিয়োজিত। বাসার বুয়া নামেই তাদের পরিচয়। তাদেরও নেই কোন সাপ্তাহিক ছুটি কিংবা নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার বালাই।

বনশ্রী আবাসিক এলাকায় একটি বড়িতে দারোয়ানের চাকরি করেন ৭০ ঊর্ধ্ব হারুনুর রশীদ। বললেন, “ফয়জরের আয়যানের সময় শুরু হইয়া রাইত ১২টা পর্যন্ত কাজ।”

সে হিসাবে দৈনিক ১৯ থেকে ২০ ঘণ্টা কাজ তার। নেই কোন সাপ্তাহিক ছুটি বা অতিরিক্ত শ্রমের জন্য কোনো ভাতা।

হারুনুর রশীদ বার্তা২৪.কমকে জানান, তিন বছর আগে এই বাসায় ১০ হাজার বেতনে চাকরি শুরু করেন। এ পর্যন্ত আর বেতন বাড়েনি।

মালিক বলছে বেতন বাড়বে না। এই বেতনেই কাজ করতে হবে। শুধু দুই ঈদে বোনাস ছাড়া আর কোন সুযোগ সুবিধা নেই।


মাসুদ ও হারুনের মতো একই অবস্থা রামপুরা এলাকার মুদি দোকানের সেলসম্যান সোহরাব হোসেনের। বার্তা২৪.কমকে তিনি বলেন, “সকাল সাড়ে সাতটায় দোকানে আসা লাগে। দুপুরে এক ঘন্টার বিরতি দিয়ে রাতে দোকান বন্ধ হওয়া পর্যন্ত থাকা লাগে।”

মুদি দোকান হওয়ায় সপ্তাহে সাতদিন খোলা, সাতদিনই কাজ। ফলে চাইলেও পরিবারকে সময় দেওয়া সম্ভব হয় না সোহরাবের পক্ষে।

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর ১০০ ধারায় বলা আছে, কোনও শ্রমিক প্রতিদিন আট ঘণ্টার বেশি কাজ করবে না। সপ্তাহে অন্তত একদিন ছুটি থাকতে হবে। আট ঘণ্টা কাজ করার জন্য নূন্যতম আধ ঘণ্টার বিরতি দিতে হবে। ১০৩ ধারা অনুযায়ী বিশেষ প্রয়োজনে কর্মচারীর মত নিয়ে বাড়তি সময়ের জন্য কাজ করানো যেতে পারে, তবে তার জন্য বাড়তি মজুরি দিতে হবে। বাড়তি কাজ রাতে করলে পরবর্তী দিন ছুটি দিতে হবে। বাড়তি মজুরির বিষয়ে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে ১০৮ ধারায়, সেখানে লেখা আছে-যে ক্ষেত্রে কোনও শ্রমিক কোনও প্রতিষ্ঠানে কোনও দিন বা সপ্তাহে এই আইনের অধীনে নির্দিষ্ট সময়ের অতিরিক্ত সময় কাজ করেন, সে ক্ষেত্রে তিনি অধিককাল কাজের জন্য তাহার মূল মজুরি অন্তর্বর্তী মজুরি থাকে, এর সাধারণ হারের দ্বিগুণ হারে ভাতা পাবেন।

এসবই মাসুদ, হারুন, সোহরাবদের কাছে স্রেফ ‘কাজির গরু’! কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই! 

;

উল্টে গেছে দিন-রাত, পাল্টায়নি জীবন



অভিজিত রায় কৌশিক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা ২৪

ছবি: বার্তা ২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

‘আমি এক যাযাবর।
পৃথিবী আমাকে আপন করেছে, ভুলেছি নিজের ঘর।
আমি এক যাযাবর।
আমি এক যাযাবর।
আমি গঙ্গার থেকে মিসিসিপি হয়ে ভল্গার রূপ দেখেছি।
অটোয়ার থেকে অস্ট্রিয়া হয়ে প্যারিসের ধুলো মেখেছি।’

ভূপেন হাজারিকার গানের কথাগুলোর মতোই যেন কায়িক শ্রমিকদের জীবন। যারা ঘরের মায়া ছেড়ে পরিবার থেকে দূরে এসে দুমুঠো খাবারের সন্ধানে রাতকে করেছেন দিন। আর দিন করেছেন রাত। তবে শ্রমের গ্যাড়াকলে দিন-রাতের হিসেবটা পাল্টে গেলেও পাল্টায়নি এসব শ্রমজীবীর মানুষের জীবন। দিন-রাত খেটে মরলেও হয়নি সামান্য উন্নয়নের ভাগিদার।

বলা হচ্ছে- বালু ও কয়লা শ্রমিকদের কথা। ভূপেন হাজারিকার গানে প্যারিসের ধুলো মাখার কথা বলা হলেও এসব মানুষের কপালে জুটেছে গাবতলী ও আমিন বাজারের সংলগ্ন তুরাগ নদীতে গড়ে ওঠা কয়লা ও বালি ব্যবসার ধুলো। পরিশ্রমী এসব মানুষের শরীরের ঘামে কয়লা-বালির ব্যবসায় এসেছে প্রসরতা। যার সুবিধা ভোগ করছে বিত্তশালীরা। অন্যদিকে ‘নুন আনতে পান্তা ফুরানো’র মতো শ্রমিকদের অবস্থা।

তুরাগে সরজমিনে দেখা যায়, বাঁশ-পলিথিনের তৈরি অসংখ্য খুপড়ি ঘর। বেলা বেড়ে দুপুর গড়ালেও সেখানে প্রতিটি ঘরে শুয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন শ্রমিকরা। কারণ এরাই রাতকে দিন বানিয়ে ভাগ্য বদলানোর বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছেন বছরের পর বছর।


তাদের মধ্যে মো. রানা হোসেন। আমিন বাজার ল্যান্ডিং স্টেশনে কাজ করেন। স্ত্রী ও ছেলে মিলিয়ে তিনজনের সংসার। বাবা-মা থাকেন গ্রামে। পরিবারের একটু সচ্ছলতার জন্য রাতে কাজ করেন তিনি। পাশাপাশি দিনের অর্ধবেলা ঘুমিয়ে বাকি অর্ধ বেলা করেন পানের দোকানদারি। আর নারী শ্রমিকরা করেন বিভিন্ন দোকানে পানি বয়ে দেওয়ার কাজ।

রানা হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেন, দিন দিন খরচ বাড়ছে। সবকিছুর দাম বাড়ছে কিন্তু আমাদের ইনকাম বাড়ছে না। এখন সবকিছুর যে দাম সারাদিন ইনকাম করেও একদিনের খরচ জোগানো অসম্ভব। বাড়িতেও টাকা পাঠাতে হয়। আবার নিজেদেরও বিভিন্ন খরচ থাকে। এই খরচ জোগার করতেই সারা রাত ঘাটে মাল আনলোডের কাজ করি। দিনের বেলা অধিকাংশ সময় ঘুমাই। আবার ঘুম থেকে উঠে একটা পানের দোকান আছে সেখানে বসি। বউও কাজ করে। বিভিন্ন দোকানে পানি টেনে দিয়ে সামান্য কিছু ইনকাম হয়। দুইজনের এই ইনকামের টাকায় সংসার চলে।

ময়মনসিংহ থেকে এসেছেন আবির আহমেদ। প্রায় ৫ বছর ধরে কয়লা-বালি লোড আনলোডের কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘বাড়িতে মা-বাবাসহ ৫ জনের পরিবার। আব্বা অন্যের জমিতে কৃষি কাজ করেন। খুব বেশি টাকা ইনকাম করতে পারে না। আমি কাজ করে যে টাকা পাঠায় সেই টাকায় সংসার চলে। আমরা রাতের বেলা কাজ করি। রাতে এখান থেকে গাড়ি লোড হয়ে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় বালি পাঠানো হয়। তাছাড়া জাহাজ আসলে সেগুলো আনলোডও করতে হয়। সারা রাত জেগে কাজ করি আর দিনের বেলা অধিকাংশ সময় ঘুমা্ই।


আরেক শ্রমিক বলেন, ‘আমরা ভোর থেকে কাজ শুরু করি। যতক্ষণ ক্লান্তি না আসে ততক্ষণ কাজ করতে থাকি। কাজ করলে টাকা পায়। না করলে না খেয়ে থাকতে হয়। আমাদের টালি গুণে টাকা দেয়।

শ্রমিকরা জানান, ৮ ঝুড়ি বালি টানলে ২০ টাকা পাওয়া যায়। আবার কোন সময় ৬ ঝুড়ি বালি টানলেও ২০ টাকা পান তারা। সারাদিন বালি টেনে যতগুলো ‘টালি’ হয় দিনশেষে সেই টালি গুণে টাকার হিসাব হয়। এই শ্রমিকদের নির্দিষ্ট কোন বেতন নেই, তেমনি কাজের সময়ও নির্ধারিত না।

‘কর্মক্ষেত্রে দিন ও রাতের কাজের আলাদা মজুরি হওয়া উচিত’ বলে মনে করেন বাংলাদেশ শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি (সম্পাদক নির্বাহী পরিষদ, বিলস) আবুল কালাম আজাদ। ‘দিনে এবং রাতে কাজের মজুরি পার্থক্য হওয়া উচিত। কিন্তু সেটা দেয়া হয় না। এটা শোষণের আরেকটি নমুনা’- বলেন আজাদ।

‘দেশের প্রচলিত শ্রম আইন হচ্ছে, রাতে যাদের কাজ করানো হবে তাকে কোন ভাবে তার অনুমতি ছাড়া কাজ করাতে পারবে না। আর যদি রাতে কাজ করাতে হয় তাহলে তাকে ওভারটাইম হিসেবে মজুরি দিতে হয়। তার মানে আপনি দিনে ৮ ঘণ্টার কাজে যে মজুরি পান রাতে কাজ করলে সেই মজুরির দ্বিগুণ দিতে হবে। কিন্তু বর্তমানের কোন শ্রমিকদের দ্বিগুন মজুরি দেয়া হয় না।’

আবুল কালাম আজাদ বলেন, একটা মানুষের দিনের ঘুম আর রাতের ঘুমের পার্থক্য আছে। একজন শ্রমিকের ভালো থাকতে সুস্থ্য থাকতে রাতের ঘুম দরকার। কিন্তু সেটা তো আর হয় না। তাই রাতে কাজ করা শ্রমিকদের অতিরিক্ত মজুরি অবশ্যই দেয়া উচিত। আমার ধারণা মালিকপক্ষ সেটা করেন না। ফলে নিরুপায় হয়ে শ্রমিকরা এই মজুরিতে কাজ করেন।

;