এনজিও ব্যুরো, সমাজসেবা বা সরকারি কোন প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নেই। কিন্তু এনজিও সংস্থা উল্লেখ করে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে রোহিঙ্গা শিবিরে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে ‘ডোল ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটি নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠান। রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত না যেতে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থ যোগান দিচ্ছে এনজিওটি এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরে নানা অপতৎপরতা চালিয়ে গেলেও প্রশাসনের ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি। নগদ অর্থ বিতরণ, মাংস বিতরণসহ কিছু কাজ দৃশ্যমান করে গেলেও এই সংস্থার বেশির ভাগ কর্মকাণ্ডই অদৃশ্য। রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সংগঠিত করার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করে বলে অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। রোহিঙ্গা শিবিরে গোয়েন্দা সংস্থার নজর এড়িয়ে ক্যাম্পের বিভিন্ন জায়গায় ‘বাংলাদেশ-আরকান ২০১৮’ এবং ‘বাংলাদেশ-আরকান ২০১৭’ লেখা অনেকগুলো গেইট, সাইনবোর্ড, ব্যানার টাঙিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরের একটি জায়গাকে ‘আরকান’ হিসেবে তুলে ধরায় জনমনে নানা কৌতুহল ও শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
নিবন্ধিত কোনো এনজিও সংস্থা না হওয়া স্বত্বেও ডোল ইন্টারন্যাশনাল নামের এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা অবৈধ অর্থায়ন হয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। যার বেশির ভাগই ব্যবহার হয়েছে দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডে। রোহিঙ্গাদের উসকে দেওয়াসহ বিভিন্ন কাজে নিয়মিত অর্থায়ন হয় প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে।
জেলা প্রশাসনের এনজিও তদারক শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডোল ইন্টারন্যাশনাল নামে তাদের তালিকায় কোন এনজিও নেই। যদি ক্যাম্পে কাজ করে থাকে সেটি সম্পূর্ণ অবৈধ। একইভাবে এনজিও ব্যুরোতেও খোঁজ নিয়ে ডোল ইন্টারন্যাশনালের কোন অস্থিত্ব পাওয়া যায়নি।
অভিযোগ আছে, এই সংস্থার লোগো সম্বলিত বিভিন্ন ব্যানার দিনের পর দিন ক্যাম্পে ব্যবহার হলেও প্রশাসন নজর দেয়নি। অভিযোগ আছে, এই প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড ব্যবহার করে প্রায় সময়ই ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে এসে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করছে পাকিস্তানি নাগরিকরা।
সংস্থাটি যে ব্যক্তি চালাচ্ছে তাকে ঘিরেও জনমনে নানা প্রশ্ন ও রহস্য বিরাজমান। ডোল ইন্টারন্যাশনাল নামে ভূয়া এই প্রতিষ্ঠানটির মালিক মো. সাইদুল ইসলাম নামে এক যুবক। ব্যক্তিগত পাসপোর্টের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সাইদের বয়স ২৪ বছর। সাইদের বাবার নাম মো. নজরুল ইসলাম। তার বাড়ি কক্সবাজারের চকরিয়ার উপজেলার চিরিঙ্গা ৩নং ওয়ার্ডের রুস্তম আলী চৌধুরী পাড়ায়। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া সাইদকে পড়াশোনা করানোর মত সামর্থ ছিল না তার বাবা-মায়ের। তাই তাকে ছোটবেলায় চকরিয়ার একটি মাদ্রাসার এতিম খানায় দিয়ে দেন। এতিম খানায় বেড়ে উঠা সাইদ বর্তমানে শত কোটি টাকার মালিক। শুধুমাত্র ২০১৭ সালে এক বছরে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের একটি শাখায় লেনদেন করেছেন ৯ কোটি টাকা।
এতিম খানায় বড় হওয়া সাইদের হঠাৎ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করে বার্তা ২৪.কম। অনুসন্ধানে পিলে চমকানো তথ্য বেরিয়ে আসে। এসএসসি পাশ করা পর্যন্ত সাইদ এতিম খানায় ছিল। পরে তার ফুফির সহযোগিতায় কলেজে ভর্তি হয়। কলেজ জীবন থেকেই ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত। এক পর্যায়ে চট্টগ্রাম থেকে চকরিয়ায় ফেন্সিডিল পাচারে জড়িয়ে পড়ে। ফেন্সিডিল ব্যবসার ফাঁকে চকরিয়ার সাহারবিল এলাকার একটি মাদ্রাসা পরিচালনার সাথে জড়িত হন। ওই মাদরাসার ফান্ড থেকে বেশকিছু টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে আসেন কক্সবাজারে। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ।
তবে ২০১৭ সালের আগস্টের শেষের দিকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢল আসলে সাইদের ভাগ্যে নতুন চাঁদ উঠে। সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থার নজর এড়িয়ে ডোল ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি নাম স্বর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে রোহিঙ্গা শিবিরে অবৈধ কর্মকাণ্ড শুরু করে।
শিবিরের রাজনীতি করার সুবাধে সাইদের সাথে পরিচয় হয় পাকিস্তানি নাগরিকের। পাকিস্তানী নাগরিকের সহায়তায় রোহিঙ্গা শিবিরে কু-উদ্দেশ্য হাসিলে নেমে পড়েন তিনি। এরপর থেকে কক্সবাজার শহরের কলাতলীতে বিশাল একটি ভবন ভাড়া নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন নানা অপতৎপরতা।
অনুসন্ধ্যানে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের জন্য গত দেড় বছরে শত কোটি টাকা বিদেশি অর্থায়ন নিয়ে এসেছেন সাইদুল ইসলাম নামের এই যুবক। কিন্তু এসব টাকা নিয়ম অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের কল্যাণে ব্যবহার হয়নি। রোহিঙ্গাদের উগ্রতা ছড়াতে ব্যবহার হয়েছে অবৈধ এ অর্থায়ন। সাইদকে অর্থায়ন করে রিভাত, এসকেটি, উইকেয়ার, ইলিকদার সহ বেশকিছু বিদেশি সংস্থা। এসব সংস্থা পাকিস্তানি, দক্ষিণ আফ্রিকা ও তুরস্ক ভিত্তিক। এসব এনজিও’র বাংলাদেশে কাজ করার কোনো অনুমতি নেই। কিন্তু সাইদের মাধ্যমে অবৈধভাবে তারা দীর্ঘদিন ধরে গোপনে রোহিঙ্গা শিবিরে কাজ করে যাচ্ছে। যার বেশকিছু প্রমাণ এ প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে।
বিদেশি অর্থায়ন সাইদের পকেটে আসে ‘নাদিয়া এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নামীয় ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে। এই প্রতিষ্ঠানেরও মালিক সাইদুল ইসলাম। নাদিয়া এন্টারপ্রাইজের ব্যাংক একাউন্ট অনুসন্ধান করে জানা গেছে, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক লিংকরোড শাখায় এই প্রতিষ্ঠানের নামে একটি অ্যাকাউন্ট আছে। ওই অ্যাকাউন্টে ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে প্রায় ৯ কোটি টাকা। এরপর ২০১৮ সালেও বিপুল পরিমাণ টাকা লেনদেন হয়েছে। এছাড়াও ইসলামী ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ঢাকা এবং কক্সবাজারের বিভিন্ন শাখায় কোটি কোটি টাকা লেনদেন করেছেন সাইদ।
জানা গেছে, উখিয়া-টেকনাফের যেসব স্থানে রোহিঙ্গারা আশ্রিত রয়েছে সেটিকে সাইদ এবং তার সিন্ডিকেটে জড়িতরা আরকান রাজ্যের অংশ মনে করে থাকে। রোহিঙ্গাদের মধ্যেও এই ধরণের মনোভাব সৃষ্টি করার জন্য নানা অপতৎপরতা চালাচ্ছে। এজন্য ক্যাম্পের বিভিন্ন জায়গায় ডোল ইন্টারন্যাশনালের লোগো সম্বলিত ‘বাংলাদেশ আরকান’ লেখা সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে।
সাইদের ঘনিষ্ট এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তা২৪.কমকে বলেন, কয়েক বছরও এতিম খানায় বড় হওয়া সাইদের মারাত্মক আর্থিক দৈন্যদশা ছিল। রোহিঙ্গা শিবিরে অপতৎপরতা চালানোর জন্য বিদেশ থেকে অবৈধভাবে অর্থায়ন এনে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন। রোহিঙ্গারা শিবিরে নানা অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে সাইদ। সম্প্রতি এক কোটি টাকার বিনিময়ে ঢাকার উত্তরা মা ও শিশু হাসপাতাল নামে একটি বেসরকারি হাসপাতালের ডাইরেক্টরশিপ কিনেছেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বার্তা২৪.কমকে বলেন, ডোল ইন্টারন্যাশনাল নামে প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণ অবৈধ। ডিসি অফিস, ইউএনও অফিস বা আরআরআরসি কোথাও এই প্রতিষ্ঠানের নাম নেই। সংস্থাটি মূলত রোহিঙ্গা শিবিরে গোপনে অবৈধভাবে নানা অপতৎপরতা চালাচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিকারুজ্জামান বার্তা২৪.কমকে বলেন, ডোল ইন্টারন্যাশনাল নামে কোন এনজিও তালিকায় নেই। যদি ক্যাম্পে কাজ করে থাকে তাহলে গোপনে অবৈধভাবে করেছে। খোঁজ খবর নিয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আশরাফুল আবসার বার্তা২৪.কমকে বলেন, জেলা প্রশাসনের তালিকায় এ নামে কোনো এনজিও নেই। খোঁজ খবর নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এবিষয়ে জানতে চাইলে ভূয়া এনজিও ডোল ইন্টারন্যাশনালের মালিক সাইদুল ইসলাম নানা যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করেন এ প্রতিবেদককে। এক পর্যায়ে সাইদও স্বীকার করেন ডোল ইন্টারন্যাশনাল কোনো এনজিও নয়। প্রশাসনের কড়াকড়ি না থাকার সুযোগে তারা কাজ করেছে।
রোহিঙ্গা শিবিরে ‘বাংলাদেশ-আরকান’ লেখা গেইট বা ব্যানার টাঙানোর সম্পর্কে জানতে চাইলে সাইদ বার্তা২৪.কমকে বলেন, রোহিঙ্গারা আরকানের নাগরিক। তারা যেখানে আছে সেটি এখন আরাকান হিসেবে মনে করে থাকে। অর্থ্যাৎ উখিয়ায় যেহেতু রোহিঙ্গারা বসবাস করছে তাই এটি এখন আরাকান। তাই এটি লেখা হয়েছে দাবি করেন তিনি। বিদেশী অর্থায়নের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর দেননি। আমি ঢাকা থেকে ফিরে আপনার সাথে দেখা করবো বলেও জানান তিনি।