মৃতপ্রায় সাইডুলী, বেকার জেলেপাড়া

নেত্রকোনা, দেশের খবর

মো. জিয়াউর রহমান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, নেত্রকোনা, বার্তা২৪.কম | 2023-08-26 15:47:07

এক সময়ের নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার খরস্রোতা সাইডুলী নদীটি এখন মৃতপ্রায়। প্রায় ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ৩০০ থেকে ৪০০ ফিট প্রস্থ মগড়া নদীর শাখা নদী সাইডুলী রূপ-লাবণ্য আর মৎস্য সম্পদে ছিল সমৃদ্ধ। কয়েক বছর আগেও এই নদীপথ দিয়ে চলতো ছোট বড় অসংখ্য নৌকা। নদীতে পাল তোলা নৌকার মনোরম দৃশ্য দেখে দৃষ্টি আটকে যেতো যে কারও।

কিন্তু কালের আবর্তে সাইডুলী নদীর সেই রূপ-লাবণ্য ও সমৃদ্ধ মৎস্য সম্পদ কোনোটাই আজ আর নেই। সাইডুলী নদীতে এখন আর দেখা মেলেনা বাহারি সব নৌকা চলাচলের দৃশ্য। অথচ এক সময় এই নদীপথে ধান, পাটসহ বাণিজ্যের মালামাল নৌকায় পরিবহন করা হতো। নদীপথে বাণিজ্য কেন্দ্র করেই তখন সাইডুলী নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য দোকান পাট। বাণিজ্য মোকাম ও নৌ ঘাট গোগবাজার। আজ না আছে সাইডুলীর সেই পানি প্রবাহ, না আছে নৌ ঘাট ও বাণিজ্য মোকাম। অতীতের স্মৃতি ধারণ করে কালের সাক্ষী হয়ে গোগবাজারই শুধু রয়ে গেছে।

বর্ষা মৌসুমে ৩-৪ মাস সাইডুলীর বুকে কিছুটা পানি প্রবাহ থাকে। এছাড়া সারাবছরই সাইডুলী আর নদীরূপে থাকে না। বর্তমানে এ নদী মৃতপ্রায়। নদীর সব রূপ-লাবণ্য হারিয়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে। নদী পানিশূন্য হয়ে শুকিয়ে গেছে। অনেক স্থানে চর পড়েছে। এলাকার সাধারণ মানুষ নদী পারাপার হচ্ছেন পায়ে হেঁটেই। নদীর বুক জুড়ে তৈরি হয়েছে অসংখ্য বীজতলা। কোথাও কোথাও চাষ করা হয়েছে ধান ও সরিষাসহ নানা রকম ফসল।

নদীর এমন করুন দুর্দশার প্রভাব পড়েছে নদী তীরবর্তী গ্রামগুলোর কৃষকসহ জেলে পরিবারগুলোর জীবনেও। বোরো মৌসুমে এই নদীর পানির মাধ্যমে সেচ দিয়ে এলাকার কৃষরা তাদের জমি চাষাবাদ করতেন। কিন্তু নদীতে পানি না থাকায় কৃষকরা তাদের বোরো চাষ করতে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। অপরদিকে এই সাইডুলী নদীই ছিল নদী তীরবর্তী জেলে পরিবারগুলোর জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উপায়।

কিন্তু দখল, দূষণ ও নাব্যতা সংকটসহ নানাবিধ কারণে নদীর এমন বেহালদশায় জেলেরাও হয়ে পড়েছে কর্মহীন। নদীতে পানি ও মাছ দুটোই না থাকায় জেলেরা অনেকেই পেশা বদল করেছেন। কেউ কেউ আবার জীবিকার তাগিদে হয়েছেন এলাকা ছাড়া।

সাইডুলী নদী তীরবর্তী নওপাড়া ইউনিয়নের কাউরাট গ্রামের মৎস্যজীবী জুনায়েদ মিয়া জানান, এই নদীতে মাছ ধরে এবং তা বিক্রি করেই জেলেদের সংসার চলত। কিন্তু এখন নদী আর নদী নাই। নদীতে পানি নাই, মাছও নাই। তাই জেলেরা কর্মহীন অবস্থায় বেকার ও পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। অনেকেই এ পেশা ছেড়ে অন্য কাজ করছেন। আবার কেউ সংসার চালাতে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন বলেও তিনি জানান।

একই গ্রামের কৃষক মুক্তুল হোসেন বলেন, 'নদী ভরাট হয়ে গেছে। পানি নাই। তাই কৃষকরা বোরো চাষ নিয়ে অনেক দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। নদীতে পানি না থাকা বিকল্প ব্যবস্থায় সেচ দিয়ে চাষাবাদ করতে হচ্ছে।'

নদী তীরবর্তী কান্দিউড়া ইউনিয়নের জালালপুর গ্রামের প্রবীণ জালাল উদ্দিন বলেন, 'সাইডুলী এক সময় বিশাল নদী ছিল। সারাবছর নদী দিয়ে বড় বড় নৌকা চলাচল করতো। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নৌকার মাধ্যমে এ নদী দিয়ে ধান, পাট আমদানি-রফতানি করা হত এবং গোগবাজার নৌ ঘাট ও বাণিজ্য মোকাম হিসাবে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু আজ সে সবের কিছুই নাই। নদী আর নদী নাই। ভরাট হয়ে গেছে। পানি নাই। মাছ নাই।' 

তাই অবিলম্বে সাইডুলী নদী খনন করে নদীর পানি প্রবাহ ফিরিয়ে দেওয়া, স্থানীয় জেলেদের কর্মসংস্থান ও এলাকার কৃষকদের চাষাবাদের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়ার জন্যও তিনি সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষে সুদৃষ্টি কামনা করেন।

এ বিষয়ে কেন্দুয়া উপজেলার সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মুহাম্মদ দেলোয়ার হোসাইনের সাথে কথা হলে তিনি সাইডুলী নদীর বেহালদশার কথা স্বীকার করে বার্তা২৪.কমকে জানান, বর্ষা মৌসুমে নদীতে অভয়াশ্রম স্থাপনের মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে জরুরি মৃতপ্রায় এই নদীটি খননসহ প্রয়োজনীয় সংস্কার করা দরকার।

নদী তীরবর্তী জেলে পরিবারগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'প্রাথমিকভাবে নিবন্ধনের মাধ্যমে জেলেদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সরকারের পরবর্তী নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

এ সম্পর্কিত আরও খবর