‘আমার তো জামাই নাই। একটা ছ্যাড়া আছিন, হেইডাও মইর্যা গেছে। তয় তিনডা মাইয়্যা আছিন, হ্যাগোর বিয়া অইয়্যা গেছে। অহন ঘরে বইয়্যা থাকলে আমারে খাওয়াইবো কেডা? হেরলেইগ্যা ঘুইর্যা ঘুইর্যা ভিক্ষা করি। খিদা লাগলে পেডেতে কিছুতো দেওন লাগে।’
বার্তা২৪.কমের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে কথাগুলো বলছিলেন বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়া ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা আমেনা খাতুন।
আমেনা খাতুনের বাড়ি গৌরীপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নের হিম্মতনগর গ্রামে। ওই গ্রামের খোকন মিয়ার বাড়িতে থাকেন তিনি। তার বাবার নাম হানিফ মিয়া। মা জিলুমা বেগম।
বুধবার (১৬ জানুয়ারি) বিকেলে আমেনা খাতুনের দেখা মিলে গৌরীপুর পৌর শহরের ধানমহাল এলাকায়। পলিথিনের একটি ব্যাগ ও পুঁটলি নিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে চলছিলেন তিনি। হাতে ইশারা দিয়ে ডাক দিতেই আমেনা বলেন, ‘ভিক্ষা লাগদোনা (লাগবে না)। মইসিংয়ের (ময়মনসিংহ) বাস থেইক্যা নামনের পরে মাথাডা কিরম করতাছে, অহন একটু বইবার দেন।’
স্থানীয় একটি দোকান থেকে চেয়ার এনে আমেনার বসার ব্যবস্থা করা হয়। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পড় অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে ওঠেন তিনি। কথাবার্তায় ফিরে আসে তার প্রাণচাঞ্চল্য।
আমেনা বলেন, ‘সংগ্রামের পর লগের গেরামের তালেব মিয়ার সঙ্গে আমার বিয়া অয়। সংসারে আহে তিন মাইয়্যা ও একটা পোলা। আমরা জামাই-বউ মাইনষ্যের বাড়ি কাম কইর্যা সংসার চালাইতাম। অভাব থাকলেও সংসারডাত সুখ আছিন। এরমইধ্যে একদিন জামাই মইর্যা গেল। হেরপর মইর্যা যায় আমার ছ্যাড়া আজিবুলডা। পরে কত কষ্ট কইর্যা তিনডা মাইয়্যারে বিয়া দিছি। অ্যাহন আমার তো বয়স অইছে, তাই কেউ কাইজ-কামে নেয় না। হের লইগ্যা পেডের দায়ে মইসিং শহরে ভিক্ষা করি।’
জানা গেছে, প্রতিদিন সকালে হিম্মতনগর গ্রাম থেকে চার মাইল পথ পায়ে হেঁটে উপজেলা শহরে আসেন আমেনা। এরপর ১৫ টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে বাসস্ট্যান্ড পৌঁছে ২৫ টাকা টিকিটে বাসযোগে ময়মনসিংহ শহরে যান। সেখানে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করে প্রতিদিন তার আয় হয় ৪ থেকে ৫শ টাকার মতো। এরপর তিনি সন্ধ্যায় আবার বাসযোগে গৌরীপুর এসে পায়ে হেঁটে বাড়িতে যান।
কথা প্রসঙ্গে আমেনা খাতুন জানান, বয়সের ভারে ঠিকমতো চলতে পারেন না তিনি। তবুও তিনি পান না কোনো সরকারি ভাতা। স্থানীয় এক মেম্বার তার নামে ভাতার কার্ড দেয়ার আশ্বাস দিলেও টাকা দিতে না পারায় সেটা পাওয়া হয়নি। নিজের নামে জমি না থাকায় সরকারি ঘরের সুবিধা থেকেও বঞ্চিত তিনি। তবে এতো কিছুর পরেও দমে যাওয়ার পাত্র নন আমেনা। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ও নিজের জমানো কিছু টাকা দিয়ে ছোট্ট একটা ঘর তুলেছেন খোকনের জমিতে। এখন তার স্বপ্ন একখণ্ড জমি কেনার।
এরই মাঝে বিকেলের সূর্য পশ্চিমে হেলেছে। সড়কে জ্বলে উঠেছে নগর বাতি। এমন সময় আগমন ঘটে স্থানীয় স্কুল শিক্ষক রায়হান উদ্দিনের। আমেনাকে দেখেই তিনি বলে ওঠেন, চাচি আপনার শরীর কেমন? জবাবে আমেনা বলেন, ‘শইল্যো আমার অসুখ-বিসুখে ভরা। কোমবালা যে মইর্যা যাই। দোয়া কইরো ভাই একপোয়া (আড়াই শতক) জমি কিইন্যা সেখানে একটা ঘর তুইল্যা যেন মরতাম পারি।’
কথার রেশ টেনে স্কুল শিক্ষক বলেন, ‘জমি কিনতে তো অনেক টাকা লাগে।’ মৃদু হেসে আমেনা বলেন, ‘একপোয়া জমির দর এক লাখ টেকা। আমি টেকা জমাইতাছি। মরার আগে আমার জমিডা কিননের খুব ইচ্ছা। অহন উইঠ্যা পড়ি, বেইল যাইতাছেগা।’