মাঘের মিষ্টি সকাল। কুয়াশা ভেঙে তেজ ছড়াচ্ছে সূর্য। শীতের আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে প্রকৃতি। আর এই সাতসকালেই ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ লোক সড়কের পাশে পাটি বিছিয়ে সুই-সুতা দিয়ে জুতা সেলাই করে চলছে একমনে। মাঝে মাঝে দু’একটা দ্রুতগতির গাড়ি সড়কে ধুলা উড়িয়ে ছুটে চলেছে গন্তব্যে। বৃদ্ধ লোকটি তখন সুরক্ষা পেতে গলায় জড়ানো মাফলার দিয়ে নিজের নাক মুখ চেপে ধরছে।
বৃহস্পতিবার (১৭ জানুয়ারি) সকালে এই দৃশ্য চোখে পড়ে ময়মনসিংহের গৌরীপুর পৌর শহরের পাটবাজার এলাকার হারুন টি স্টলের সামনে।
কাছে যেতেই বৃদ্ধ লোকটি এ প্রতিনিধিকে বলে ওঠেন, ‘জুতা সিলি না কালি করবাইন?’ সাংবাদিক পরিচয় দিলে ভুল ভাঙে তার। বার্তা২৪.কমকে তিনি জানান তার নাম বাবু লাল রবিদাস। বাড়ি উপজেলার জেলখানা মোড় এলাকা মমিনপুর গ্রামে। বাবা স্বর্গীয় সুন্দর রবিদাস। দুই ভাই-বোনের মধ্যে বাবু লাল সবার বড়। অভাব-অনটনের কারণে পৈত্রিক সূত্রেই এই পেশায় আসা তার।
কথা বলতে বলতেই এক যুবকের পুরাতন জুতা সেলাই করছিলেন বাবু লাল। সুই-সুতার ফোড়নে নিপুন কৌশলে খুব দ্রুতই কাজটি সম্পন্ন করলেন তিনি। কাজ শেষে টাকা দিয়ে চলে যায় যুবক। নতুন কাস্টমারের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে বার্তা২৪.কমের সঙ্গে গল্প জুড়ে দেন বাবু লাল।
তিনি বলেন, ‘অভাবের লেইগ্যা ইশকুলে যাওয়া অয় নাই। সংরামের আগে থেইক্যাই বাপের লগে হাঁট-বাজারে বইয়্যা এই কাম করি। বাপ মইর্যা গেলেও আমি অহনো এই কামেই লাইগ্যা আছি।’
জানা গেছে, বাবু লালের বাবা-মা স্বর্গীয় হয়েছেন প্রায় ২০ বছর। দাম্পত্য জীবনে বাবু লাল বিয়ে করেছেন ফুলদাসী রবিদাসকে। তাদের সংসারে পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে রয়েছে। কিন্তু অর্থের অভাবে তার কোনো সন্তানই প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতে পারেনি। এর মধ্যে তিন ছেলে বাদল, কার্তিক, সুবল ও দুই মেয়ে রাণী, রিতা বিয়ের পর আলাদা হয়েছে। তারা বাবু লালের খুব একটা খোঁজ নেন না। বর্তমানে দুই ছেলে সুজন, পূজন, এক মেয়ে সীমা ও স্ত্রীকে নিয়েই অভাব-অনটনে চলছে তার সংসার।
স্বাধীনতার আগে থেকেই পাটবাজার এলাকায় পাটি বিছিয়ে মুচির কাজ করতেন বাবু লাল। নব্বই দশকে বাবু লাল মুচির কাজ করে প্রতিদিন ২শ থেকে ২৫০ টাকার মতো আয় করতেন। তবে সময়ের পরিক্রমায় আশপাশে আরও মুচির দোকান হওয়ায় ব্যবসায় ভাটা পড়েছে বাবু লালের। তার এখানে জুতা কালি ১৫ থেকে ২০ টাকা। এছাড়া ছেঁড়া জুতা সেলাই করে মেরামত করা হয় ৫ থেকে ১০ টাকায়। দিনশেষে তার আয় হয় এখন ৭০ থেকে ৯০ টাকার মতো।
বাবু লাল বলেন, ‘ঘরের ভিডা ছাড়া আমার আর কিচ্ছু নাই। যে টেকা কামাই করি, হেইডা দিয়া সংসার চলে না। শেষ কবে যে দুইশ টেকা কামাই করছিলাম মনেও নাই। অভাবে পইড়্যা পোলা সুজইন্যারে ওয়ার্কশপের কামে দিছি। হে অহন সংসারে কিছু দেয়, হেরপরেও টানাটানি।’
কথা প্রসঙ্গে বাবু লাল জানান, নিচু জাতের লোক হওয়ায় অনেকই তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। অভাবগ্রস্ত হলেও কেউ সাহায্য করে না।
আক্ষেপ নিয়ে বাবু লাল বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় আমরাতো মানুষ, তারপরেও কেন আমাদের ছোট চোখে দেখে? আমরাতো কারো কাছে হাত পাতি না। কেউ আমাদের সাহায্যও করতে আসে না। এমন দৃষ্টি ভঙ্গি আমাদের অনেক কষ্ট দেয়?’
বাবু লাল আরও জানান, জাতীয় পরিচয়পত্রে বয়স ভুল হওয়ায় তিনি পান না বয়স্ক ভাতা। বর্তমানে ছোট মেয়ে সীমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। নান্দাইল থেকে মেয়ের বিয়ের জন্য লোক এসেছে। কিন্তু টাকার জন্য বিয়ের আলাপটা এগোতে পারছেন না তিনি।
এরই মাঝে সকালের কুয়াশা কেটে গেছে। আকাশে খেলা করছে ঝলমলে রোদ। এমন সময় গল্পে যোগ হয় চা দোকানি হারুন। গ্যাসের চুলোয় চায়ের কেটলি বসিয়ে হারুন বলেন, ‘বাবু লাল অভাবী হইলেও খুব সৎ মানুষ। জমি বেইচ্যা বড় দুই মাইয়্যারে বিয়া দিছে। কারো কাছে হাত পাতে নাই।’
কথার রেশ টেনে বাবু লাল বলেন, ‘অহন মনে হয় হাত পাতন লাগবোরো হারুন। ছোট মাইয়্যার বিয়ার ঘর আইছে। কিন্তু আমি তো সব জমি বেইচ্যা বড় দুই মাইয়্যারে বিয়া দিয়া দিছি। ছোট মাইয়্যার বিয়ার কথা তহন ভাবি নাই।’