অস্তিত্ব হারাচ্ছে ইছামতি নদী

পাবনা, দেশের খবর

আরিফ আহমেদ সিদ্দিকী,ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, পাবনা, বার্তা২৪ | 2023-09-01 21:47:25

এক সময়ের স্রোতস্বিনী ইছামতি নদীর দু’পাড়ে অবৈধ দখল, শহরের সকল ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ের পাশাপাশি ঐতিহ্য হারিয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে পাবনার এ ঐতিহ্যবাহী নদীটি। ময়লা-আবর্জনা ফেলায় প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে বাতাস। বসবাসের অযোগ্য হচ্ছে শহর। আর নদী দখল-দূষণ রোধে নেই কার্যকরী ব্যবস্থা।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বাংলার নবাব ইসলাম খাঁ ১৬০৮-১৬১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকালে সৈন্য পরিচালনার সুবিধায় পদ্মা ও যমুনা নদীর সংযোগ স্থাপনার্থে পাবনা মধ্যশহরে একটি খাল কাটেন, যার নাম দেন ইছামতি। এক সময়ের খরস্রোতা এই নদী দিয়ে চলতো নৌকা-ছোট জাহাজ। এই নদী দিয়েই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার নিজস্ব বোটে করেই জমিদারী দেখাশুনা করতে শিলাইদহ-শাহজাদপুর কাচারিতে আসা-যাওয়া করতেন। কিন্তু সেই স্রোতস্বিনী প্রবাহমান ইছামতি তার যৌবন হারিয়ে আজ মৃত্যুর দিকে ক্রমাগত এগিয়ে চলেছে। ইছামতি নদীর অস্তিত্বই বিপন্নের পথে। মধ্য শহরে প্রবাহিত ইছামতি নদীকে এখন সবাই আক্ষেপ করে বলেন ‘ময়লা আবর্জনার ভাগাড়’ বা ‘পৌরসভার ড্রেন’। নদীর দুই পাড় দখল করে বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মহোৎসব চলছে।

শহরের সকল বাসা বাড়ি, হোটেল রেস্তোরার আবর্জনা, ক্লিনিকের যাবতীয় বর্জ্য পদার্থ ও আবর্জনা ফেলা হচ্ছে এই নদীতে। স্লুইস গেট দিয়ে পানি আটকে পরিকল্পিতভাবে নদীকে মেরে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। অব্যাহত দূষণের ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছে জেলা শহর ও এর আশ-পাশের কয়েক লাখ মানুষ।

জানা যায়, পাবনা থেকে বেড়া পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদীর প্রায় অর্ধেক এখন নর্দমা। এর মধ্যে পৌর এলাকার মধ্যে রয়েছে পাঁচ কিলোমিটার। নদী ভরাটের কারণেই সৃষ্টি হয়েছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, বর্তমানে ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধ ও মশা-মাছির আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে উৎসমুখের কাছে (বাংলা বাজারে স্লুইস গেট) প্রায় ভরাট করে ফেলায় এ নদী হয়ে পড়েছে প্রাণহীন।

১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এ নদীতে প্রবাহ ছিল। এ নদী পাবনার উত্তর প্রান্ত দিয়ে পূর্বে আতাইকুলার পাশ দিয়ে নদীরূপে এগিয়ে গেছে। সাঁথিয়া সদরের পাশ দিয়ে বেড়া সদরের বৃশালিখা এলাকার হুরাসাগর নদীতে গিয়ে যমুনায় মিশেছে।

সূত্র জানায়, ১৯৭৮ সালে পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু করার সময় ইছামতির সাথে বড়াল নদের সংযোগ মুখে নির্মাণ করা হয় স্লুইস গেট। এছাড়া বেড়ার কাছেও ইছামতির প্রান্তখাত বন্ধ করে দেওয়া হয়। বেড়া থেকে আতাইকুলা পর্যন্ত প্রায় ৩৫ কিলোমিটার ইছামতি পুনঃখনন করা হয়। বেড়া পাম্প হাউজের সাহায্যে খননকৃত অংশের নদীতে ভরে পানি রাখা হচ্ছে সেচ কাজের জন্য। কিন্তু অবশিষ্ট ২০ কিলোমিটার নদী ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। শহরের নর্দমাগুলোর চেয়ে ইছামতির তলদেশ উঁচু হয়ে উঠেছে। দখল হয়ে গেছে নদীর কিনারা। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ডিএস মৌজা ও ম্যাপ অনুযায়ী ২০০৫ সালে সর্বশেষ জরিপ কাজ চালায় জেলা প্রশাসন। সেই জরিপের তথ্য হিসেবে, নদীর উৎসমুখ সদরের চরশিবরামপুর থেকে পাবনা পৌর এলাকার শালগাড়িয়া শ্মশানঘাট পর্যন্ত দীর্ঘ ৫ কিলোমিটারব্যাপি সাতটি মৌজায় নদীর পাঁচ হাজার বর্গফুট এলাকা বেদখল হয়ে গেছে। বিভিন্ন স্থানে ১২০ থেকে দুই’শ ফুট প্রস্থের ইছামতি নদী এখন দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭০ থেকে ৮০ ফুটে। নদীর পাড় দখল করে বসবাস করা অবৈধ দখলদারদের সংখ্যা ২৮৪ জন। ২০০৫ সালে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে নদীর কিছু খনন ও পরিষ্কারের কাজ করে।

এ ছাড়া ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নদী খননের জন্য প্রায় ২৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় দুই কোটি টাকা বরাদ্দে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু বর্জ্য অপসারণ ও অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করা হলেও তা আর শেষ হয়নি।

পরিবেশবিদ প্রফেসর শাহনেওয়াজ সালাম বলেন, ইছামতি নদী মরে যাওয়ার বিরূপ প্রভাবে শহরের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে বিশুদ্ধ পানির সংকটের পাশাপাশি বিশুদ্ধ বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। নদী কেন্দ্রিক ফসল উৎপাদনও প্রায় বন্ধ।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর শিবজিত নাগ বলেন, এই নদী অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। স্বপ্ন দেখি আবারও প্রবাহমান হবে ইছামতি। আর নদীর দু’ধারে থাকবে গাছের সারি। বিনোদনের একটা জায়গা হয়ে উঠবে ইছামতি। যৌবন ফিরে পেয়ে সকলের জন্য ভূমিকা রাখবে এই নদী। ইছামতি নদী খনন করে পদ্মার সাথে সংযোগ করলে জমে উঠবে ব্যবসা-বাণিজ্য। যাতায়াতে নতুন ব্যবস্থায় সমৃদ্ধ হবে পাবনা।

ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতার সাথে আলাপকালে তারা জানান, ইছামতি নদী উদ্ধারের বিষয়ে অনেকবারই বিভিন্ন ফোরামে কথা উঠেছে। কিন্তু বারবারই পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দের অভাবে থমকে আছে।

তারা বলেন, পাবনার ৫টি সংসদীয় আসনেই ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ রয়েছেন। তারা জাতীয় সংসদে পাবনার ইছামতি নদী উদ্ধার ও পানি প্রবাহের লক্ষ্যে জোড়ালো ভূমিকা রাখলে হয়তো এই নদীর ঐতিহ্য রক্ষা করা সম্ভব হবে।

এদিকে জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন বলেন, আমি পাবনার মানুষ নই। তবে ইছামতি নিয়ে এ জেলার গৌরব রক্ষায় আমি কাজ করছি। তেমনিভাবে ইছামতি নদী উদ্ধার, প্রাণ ফিরিয়ে আনা এবং দু’পাড়ে বিনোদনের স্পট করার বিষয়টি মাথায় নিয়েই এগুচ্ছি। পাবনাবাসী সামাজিক ভাবে নদী উদ্ধারের আন্দোলনের সাথে সাথে আমরাও সরকারের নদী উদ্ধারে বিভিন্ন নির্দেশনানুযায়ী কাজ করছি।

এদিকে, পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালে ইছামতি নদী পুনঃখনন ও পাবনা শহর এলাকার পরিবেশ উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রায় ১০ কোটি টাকার এই প্রকল্প পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় ২০০৪ সালের ৮ জানুয়ারি। কিন্তু পরে সেই প্রকল্পটি আর বাস্তবায়ন হয়নি। সরকারি নির্দেশনানুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আমরা প্রস্তুত।

পাবনা সদর আসনের পরপর তিনবারের নির্বাচিত সাংসদ, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্স বলেন, নদী উদ্ধারের বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। এই ইস্যু এখন স্থানীয় নয়, জাতীয় ইস্যু। আর প্রধানমন্ত্রী নিজেই এই প্রকল্পের তদারকি করছেন।

সাংসদ প্রিন্স বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নজর পাবনার ইছামতি নদীর দিকেও আছে। পাবনাবাসীর প্রাণের দাবী ইছামতি নদীর অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ, নদীর পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনা, বিনোদনের ব্যবস্থা সবই হবে।

ইছামতি নদীর দু’পাড়ের অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করে, নদীতে পানি প্রবাহ নিশ্চিত করা পাবনাবাসীর প্রাণের দাবীতে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই নদী উদ্ধারে পাবনায় একের পর এক আন্দোলন চলে আসলেও কার্যত কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় হতাশ হয়ে পড়েছেন জেলাবাসী।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর