বাংলাদেশের ৭টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও দশটি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া অন্যতম। চিরহরিৎ এ বনাঞ্চল বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের নিরাপদ আবাসস্থল। এছাড়াও নানান দুর্লভ জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ আর গাছপালার জন্য এ অরণ্য বিখ্যাত। সুন্দরবনের পরেই পর্যটকদের কাছে বেশি জনপ্রিয় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান।
জানা গেছে, একসময় লাউয়াছড়ায় জীববৈচিত্র্যেও মিলন মেলা দেখা যেতো অনেক। মানবসৃষ্ট সংকটে ঐতিহ্য ধরে রাখতে হিমশিম খাওয়া এই উদ্যানটি এখন অনেকটাই ধ্বংসের প্রান্তে। ওখানকার চলমান সংকটের তালিকা প্রতিনিয়তই দীর্ঘ হচ্ছে। কিন্তু চলমান এ সংকট নিরসনে নেই কোনো মহাপরিকল্পনা কিংবা স্থায়ী উদ্যোগ। দিন দিন সংকটে ‘লাউয়াছড়া’ জাতীয় উদ্যানের জীববৈচিত্র্য। সংরক্ষিত এই বনটির নেই সেই জৌলুস। অবৈধ দখল, অবাধে গাছ কাটা, বন্যপ্রাণী নিধন ও জনবল সংকট- এ চার কারণে হুমকিতে পড়েছে লাউয়াছড়া উদ্যান।
অভিযোগ আছে, কতিপয় প্রভাবশালী মহল অবৈধ দখল প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। প্রায় প্রতিদিন এ অসাধু চক্র বনের মূল্যবান গাছ কেটে নিচ্ছে। দখলের কারণে এ বনের জীববৈচিত্র্য এবং বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলও হুমকির মুখে পড়েছে। এ ছাড়া বনের হরিণ, পাখি ও খরগোশ শিকার করায় কমে যাচ্ছে এ বনের বন্যপ্রাণীর সংখ্যা।
বিশ্বের বিলুপ্তপ্রায় জীববৈচিত্র্যময় বন গবেষণা কেন্দ্রসহ এই উদ্যানে রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণীর বিচরণ। লাউয়াছড়ায় ৪৬০ প্রজাতির জীববৈচিত্র্যের মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী এবং ১৭ প্রজাতির পোকামাকড় রয়েছে। নানা সমস্যা ও সংকটে ওখানকার প্রাণী ও জীববৈচিত্র্যগুলো এখন অনেকটাই বিলুপ্তির পথে।
তবে চলমান এ সংকট নিরসনে নেই কোনো মহাপরিকল্পনা কিংবা স্থায়ী উদ্যোগ। নানা কারণে দীর্ঘদিনের বয়ে চলা সংকটগুলো ঘনীভূত হয়ে এখন মহা হুমকিতে পড়েছে ওখানকার নানা দুর্লভ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর বাসস্থান, জীবন জীবিকা ও পরিবেশ। প্রতিনিয়তই খাদ্য, নিরাপদে অবাদ বিচরণ ও বাসস্থানের আয়তন ছোট হচ্ছে ওই সকল বন্যপ্রাণীদের। আর এ কারণেই দিন দিন পরিসংখ্যানও কমছে ওখানে ঠাঁই নেয়া বিশ্বের বিরল প্রজাতির বন্যপ্রাণী, উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যের।
এদিকে, সংকট উত্তরণে (মাঠ জরিপ ও সমীক্ষা শেষে) বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন পরামর্শ দিলেও তা আমলে নিচ্ছেন না কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এমন উদাসীনতায় বিলীনের পথে ওখানকার জীববৈচিত্র্য ও বনজসম্পদ।
সরেজমিন লাউয়াছড়া উদ্যান ঘুরে দেখা গেছে, এ উদ্যানের ডরমেটরি টিলা সংলগ্ন পূর্ব এলাকায় প্রায় ১৫ একর জমি অবৈধভাবে দখল করে লেবু বাগান করা হচ্ছে। এছাড়া পশ্চিম পাশে অফিস সংলগ্ন আরও একটি টিলার প্রায় ১৫ একর জমি দখলে নিয়ে লেবু ও আনারস বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। লেবু ও আনারস বাগান ঘেঁষা টিলাগুলোতে গাছগাছালি, লতাগুল্ম ও টিলা কেটে নতুন করে বাণিজ্যিকভাবে আবাদের জন্য তৈরি করা হচ্ছে। এসব টিলায় টিনশেড ঘর তৈরি করা হয়েছে। ফলে এ উদ্যানের বাসিন্দা বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল সংকুচিত হয়ে আসছে। জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন। পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তবে এসব বিষয়ে বন বিভাগের বন্যপ্রাণী বিভাগের তেমন তৎপরতা দেখা যায়নি।
এলাকার বাসিন্দারা জানান, এলাকার একটি প্রভাবশালী চক্র অবৈধ দখল প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। তারা এলাকার প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থেকে এসব কাজ করে চলেছে। এ ছাড়া অপর একটি গ্রুপ রাতের আঁধারে এ বনের দামি গাছ-গাছালি কেটে নিচ্ছে। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না থাকায় এ জাতীয় উদ্যানে মরছে নিশাচর বন্যপ্রাণী। বনের সড়ক পারাপারের সময় দ্রুতগতির গাড়ির চাকায় পিষ্ট হচ্ছে অনেক প্রাণী। কয়েকদিন আগে রাতে সড়ক পারাপারের সময় মারা যায় বিপন্ন প্রজাতির বুনো খরগোশ। এছাড়া ১২টি পদ শূন্য থাকায় প্রশাসনিক সংকট লেগেই আছে।
এব্যাপারে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সহকারী বন কর্মকর্তা আবু তাহের চৌধুরী বার্তা২৪.কম’কে বলেন, ‘আমরা বন দখলের অভিযোগ খতিয়ে দেখছি। প্রমাণ পেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘অনেক সময় নিশাচর বন্যপ্রাণীগুলো শীত মৌসুমে রাস্তার ওপর চলে আসে। কারণ শীতকালে পাহাড়ি এলাকার চেয়ে পাকা রাস্তার অংশটি অপেক্ষাকৃত উষ্ণ থাকে। ফলে রাতে হঠাৎ গাড়ির হেডলাইটের আলো দিশাহারা হয়ে যায় বন্যপ্রাণী। তখনই চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারায় তারা।’