‘স্বপ্ন ছিল শিক্ষক হব, ভাগ্যদোষে হলাম রিকশাচালক’

ময়মনসিংহ, দেশের খবর

রাকিবুল ইসলাম রাকিব, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ), বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 12:59:45

‘স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া করে শিক্ষক হব। কিন্তু ভাগ্যদোষে হয়ে গেলাম রিকশাচালক। এখন স্কুলে যাওয়ার বদলে পেটের দায়ে রিকশা চালাই। তবে পোশাক ও কথাবার্তায় স্মার্ট হওয়ায় অনেকেই আমাকে রিকশাচালক ভাবে না। তাই আমি যাত্রীও পাই কম। তবে এটা নিয়ে আমার দুঃখ নাই।’

খুবই নরম স্বরে কথাগুলো বলছিলেন রিকশাচালক ইউসুফ আলী ইয়াসিন (৪০)। তিনি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার রামগোপালপুর ইউনিয়নের নওয়াগাও গ্রামের মৃত জাফর আলী ছেলে। দুই ভাই চার বোনের মধ্যে ইউসুফ পঞ্চম।

সোমবার (৪ ফেব্রুয়ারি) রাতে রিকশাচালক ইউসুফের সঙ্গে বার্তা২৪.কম’র প্রতিবেদকের দেখা মিলে গৌরীপুর পৌর শহরের মধ্যবাজার এলাকায়। পরনে ছিল তার সাদা শার্ট-কালো প্যান্ট। গায়ে জড়ানো শীতের কোর্ট, মাথায় ওলের টুপি। শীতের রাতে অত্যন্ত পরিপাটি হয়ে তিনি রিকশা নিয়ে যাত্রীর অপেক্ষা করছিলেন।

কাছে গিয়ে ইশারায় ডাক দিতেই ইউসুফ বলেন, ‘কোথায় যাবেন ভাইয়্যা?’ সাংবাদিক পরিচয় দিলে ভুল ভাঙে তার।

যাত্রীর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে বার্তা২৪.কম’র সঙ্গে গল্প জমে উঠে ইউসুফের। তিনি বলেন, ‘আমি দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার দরিদ্র কৃষক বাবা প্যারালাইসিস হয়ে বিছানায় পড়ে যায়। তখন অভাবের কারণে দিনে একবেলাও ভাত খেতে পারতাম না।’

তিনি আরও বলেন, ‘সংসারের হাল ধরতে স্কুল ছেড়ে কাজ নেই ঢাকায়। চার বছর সেখানে কাজ করে বাড়ি চলে আসি। কাজ নিই গৌরীপুরের একটি হোটেলে। কিন্তু হোটেল মালিক সকাল ৭টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত কাজ করাত। তাই বাধ্য হয়ে কাজ ছেড়ে দিয়ে রিকশা চালানো শুরু করি। এরপর থেকে প্রায় ২৫ বছর কেটে গেছে এই পেশায়।’



ইউসুফের বাবা মারা গেছেন ২৪ বছর আগে। বয়সের ভারে তার মা আমেনা খাতুনও বিছানায় পড়ে আছেন। দাম্পত্য জীবনে ইউসুফের স্ত্রী ও তিন ছেলে রয়েছে। এর মধ্যে বড় ছেলে প্রথম শ্রেণিতে ও ছোট ছেলে শিশু শ্রেণিতে পড়ে। সবার ছোট ছেলেটার বয়স তিন বছর।

প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত রিকশা চালান ইউসুফ। এতে তার আয় হয় ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। এই টাকা দিয়েই চলে তার সংসার, ছেলেদের পড়াশোনা ও বৃদ্ধ মায়ের চিকিৎসার খরচ।

ইউসুফ বলেন, ‘আমরা প্রয়াত শিক্ষাবিদ আশকার ইবনে শাইখের বংশধর। গরিব হলেও গুছিয়ে কথা বলি। সবসময় ভাল কাপড় পড়ি। কিন্তু যে টাকা আয় করি সেটা থেকে একসঙ্গে কাপড় কেনা সম্ভব হয় না। তাই প্রতিদিন ৫০টাকা স্থানীয় একটি কাপড়ের দোকানে জমা রাখি। এক মাস পর ১ হাজার ৫০০ টাকা জমা হলেল হলে সেখান থেকে নতুন শার্ট-প্যান্ট কিনে আনি। অবশ্য ভাল কাপড় পড়ায় লোকে আমাকে কটূক্তি করে বলে, ভাত খাইতে ভাত পায় না, সাইকেল দৌড়াইয়্যা আগতে যায়।’

অর্থের অভাবে ইউসুফ জমি কিংবা বাড়ি কিছুই করতে পারেননি। অন্যের জমিতে কুড়ে ঘর তুলে পরিবার নিয়ে থাকেন। রিকশা চালিয়ে খেয়ে না খেয়ে পরে থাকলেও কেউ তাদের খোঁজ নেয় না। সহযোগিতাও পায়না কারও কাছ থেকে। তবে এসব নিয়ে তার দুঃখ নেই। তার দুঃখ শুধু লেখাপড়া না করতে পারায়।

লেখাপড়া নিয়ে ইউসুফ বলেন, ‘আমার এখনো লেখাপড়া করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এই বয়সে তো স্কুলে ভর্তি হতে পারব না। তবে কখনো বয়স্ক শিক্ষা চালু হলে, আমি ইউসুফ ভর্তি হব।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর