ইতিহাসের সাক্ষী নীলফামারী'র নীলকুঠি

নীলফামারী, দেশের খবর

মাহমুদ আল হাসান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 21:05:50

 
নীলফামারী: ভবনটির দিকে চোখ পড়লেই হৃদয়পটে ভেসে ওঠে দরিদ্র কৃষকের ওপর অত্যাচারী নীলকরদের নির্যাতনের বীভৎস দৃশ্য। বলছি উত্তরবঙ্গের সমৃদ্ধ জেলা নীলফামারীর অতীত ঐতিহ্যবহনকারী  নীলকুঠির কথা।
 
ব্রিটিশ আমলে এ জেলায় প্রচুর পরিমানে নীল চাষ হতো। আজো এ জেলার বিভিন্ন স্থানে নীলকুঠি দেখতে পাওয়া যায়। নীলফামারী তখন নীলফামারী নামে পরিচিত ছিল না। এটি ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের নীলকুঠিয়ালাদের নীল চাষের কেন্দ্রস্থল।
 
জানা যায়, বর্তমানে নীলফামারী শহরের তিন কিলোমিটার উত্তরে ‘নটখানা’ নামে নীল খামার ছিল। তারও আগে স্থানটির নাম ছিল ‘লটখানা’। অবাধ্য নীল চাষিদের এ নীল খামারে এনে লটকিয়ে শাস্তি দেওয়া হতো বলে এর নাম ছিল ‘লটখানা’। কালের আবর্তে লটখানা শব্দটি উচ্চারিত হতে থাকে ‘নটখানা’ রূপে। নটখানা থেকে ‘নীলফামারী’ শব্দটির প্রচলন।
 
ধারণা করা হয়- স্থানীয়দের বাচনভঙ্গির কারণে ‘নীল খামার’ রূপান্তরিত হয় ‘নীল খামারী’ এবং পরবর্তীতে নীলখামারী অপভ্রংশ হয়ে নীলফামারী নামের উদ্ভব হয়েছে। আরেক মত- নীল ফার্মার পরিবর্তিত হয়েও নীলফামারী হতে পারে। তবে নামকরণ নিয়ে যে বিতর্কই থাকুক না কেন নীল চাষকে কেন্দ্র করেই যে ‘নীলফামারী’ শব্দের উৎপত্তি তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
 
নীলফামারী ডিসি গার্ডেনের সামনের এই কুঠিটি ১৯৯৯ সাল থেকে  নীলফামারী অফিসার্স ক্লাব হিসাবে ব্যবহার হয়ে আসছে। ঔপনিবেশিক স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত ৬৩ ফুট X ৫১ফুট এ টিনশেড ভবনে ২টি ফায়ার প্লেস, ২টি বেড রুম, ১টি ড্রয়িংরুম, ২টি বাথরুম ও পেছন দিকে একটি বারান্দা রয়েছে নীলকুঠিটিতে।
 
অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব ঘটলে কলে তৈরি কাপড়ের রঙের জন্য নীলের প্রয়োজন দেখা দেয়। ব্রিটিশ সরকার ভারত উপমহাদেশকে শাসন করছিল। তখন সেই সূত্র ধরে পূর্ব বাংলার কৃষককে তারা জোর করে নীল চাষ করতে বাধ্য করতো। চাষ পদ্ধতি ছিল বর্গা। জমি বর্গা নিয়ে নীল চাষ করতো কৃষক। কিন্তু নীলকর, জমির মালিকের পাওনা, চাষ খরচ- সবকিছু বাদ দিয়ে কৃষকের ভাগ্যে শূন্যের অঙ্ক বই কিছুই জুটত না। ফলে কৃষক নীল চাষে অস্বীকৃতি জানায়। আর এ কারণে তাদের ওপর নেমে আসত অপমান এবং নির্যাতন। তাদের স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে অত্যাচার চালানো হতো। এরকম অপ্রিয় ঐতিহাসিক সত্য কথাগুলোকে নতুনভাবে মনে করিয়ে দেয় এ ভবনটি।
 
এখন অনেক সময় পার হয়ে গিয়েছে। অনেক ইতিহাস বদলে গিয়েছে। সাথে সাথে বদলে গিয়েছে নীল কুঠির বাসিন্দারা। ১৮৮২ সাল থেকে এটি মহাকুমা প্রশাসকের বাসভবন, ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত এটি ছিল জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এর বাসভবন। বর্তমানে এটি নীলফামারী অফিসার্স ক্লাব হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে মজার ব্যপার হচ্ছে প্রায় ১৫০ বছর পুরনো এ ভবনটি, কোনো ধরনের পরিবর্তন ছাড়াই আজও অটুট আছে।
 
জনমনে আজ ফুটে উঠেছে- ইতিহাসের সংরক্ষণের তাগিদে সরকারিভাবে ভাবনটির সংরক্ষণের প্রয়োজন। শুধু নীলফামারীর নয়, পুরো বাংলাদেশের আগামী প্রজন্ম যেন জানতে পারে আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত থাকা এই ইতিহাস। তাই স্থানীয় জনগণের ইচ্ছা, স্মৃতিময় এ ভবনটি সংরক্ষণ করে জাদুঘরে পরিণত করা হোক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর