ঈশ্বরদীতে চাঞ্চল্যকর ৬ খুন, ধরা ছোঁয়ার বাইরে অভিযুক্তরা

পাবনা, দেশের খবর

আরিফ আহমেদ সিদ্দিকী, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, পাবনা , বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 16:33:11

গত ৬ বছরে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী ইউনিয়নে সরকারি দলের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতা এবং পুলিশের কর্মকর্তাসহ ছয় জন খুন হয়েছেন। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও দলীয় কোন্দলে এ সকল হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। অথচ এসব চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের একটিরও বিচার না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষ হতাশ ও ক্ষুব্ধ। আর অভিযুক্তরাও রয়েছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

নিহতরা হলেন, পাকশী ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের যুবলীগ নেতা মোস্তাক আহমেদ মিতু, ঈশ্বরদী উপজেলা যুবলীগের সহ-সভাপতি রফিকুল ইসলাম লাভলু, পাকশী পুলিশ ফাঁড়ির সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) সুজাউল ইসলাম, পাকশী ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ড যুবলীগের সহ-সভাপতি শাজাহান আলী, পাকশী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি সদরুল আলম পিন্টু এবং পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান সেলিম।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ১৪ মার্চ রাতে পাকশীর রেলওয়ের এমএস কলোনী এলাকায় অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে যুবলীগ নেতা মোস্তাক আহমেদ মিতু (৩০) নিহত হন। নিহত মিতু পাকশী বাজার পাড়ার আমজাদ হোসেনের ছেলে। তিনি পাকশী ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ড যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। এ ঘটনার পরদিনই নিহত মিতুর স্ত্রী মৌসুমি আক্তার বেলী বাদী হয়ে ঈশ্বরদী থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। কিন্তু গত ৬ বছরেও এ মামলার কোনো বিচার হয়নি।

২০১৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর ঈশ্বরদী উপজেলা যুবলীগ নেতা রফিকুল ইসলাম লাভলুকে (৩৫) কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। নিহত লাবলু ঈশ্বরদীর পাকশী ইউনিয়নের রূপপুর গ্রামের মৃত ঝড়ু মন্ডলের ছেলে।

লাবলু বিশ্বাসের ভাই ডাবলু বিশ্বাস জানান, ঠিকাদারি কাজ ভাগাভাগি নিয়ে ঝামেলার কারণে হয়ত তার ভাইকে দুর্বৃত্তরা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে খুন করেছে। কিন্তু গত ৫ বছরেও আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ায় তারা ক্ষুব্ধ ও শঙ্কিত।

২০১৫ সালের ৫ অক্টোবর ঈশ্বরদীর পাকশী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সহরকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) সুজাউল ইসলামকে (৩৫) নৃশংসভাবে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পাকশী রেলওয়ে কলেজের পেছনের একটি কলাবাগান থেকে হাত-পা-মুখ বাঁধা ও গলায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় তার মরদেহ উদ্ধার করে ঈশ্বরদী থানা পুলিশ। ৪ বছর পেরিয়ে গেলেও পুলিশের এএসআইকে কেন হত্যা করা হয়েছে তা আজও জানা যায়নি।

অপরদিকে ২০১৭ সালের ২৩ মার্চ পাকশী ইউনিয়নের রূপপুর গ্রামে শাজাহান আলী মন্ডল (৪৫) নামের এক যুবলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা। নিহত শাজাহান আলী পাকশীর রূপপুর গ্রামের মৃত মোহাম্মদ আলী মন্ডলের ছেলে। তিনি পাকশী ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ড যুবলীগের সহ-সভাপতি ছিলেন।

নিহত শাজাহানের ছোট ভাই জালাল উদ্দিন জানান, পদ্মা নদীর বালু বিক্রি ও রূপপুর প্রকল্পে বালু সাপ্লাইয়ের কাজ ভাগাভাগি নিয়ে পূর্বশত্রুতার জের ধরে তাকে স্থানীয় কয়েকজন সন্ত্রাসী কুপিয়ে ও পিটিয়ে আহত করে। ওই সময় তাদের দুই ভাইয়ের বাড়িঘর ভাঙচুর করে। এ ঘটনায় থানায় মামলা করার পর সন্ত্রাসীরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। নতুন রূপপুর ফুটবল মাঠ সংলগ্ন চায়ের দোকানের সামনের রাস্তায় শাজাহান আলীকে উপর্যুপরি কুপিয়ে ও ইট দিয়ে মুখমণ্ডল থেঁতলে নৃশংসভাবে হত্যা করে তারা। দুই বছর পেরিয়ে গেলেও চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি।

এছাড়া ২০১৮ সালের ২ এপ্রিল পাকশীর রূপপুর মোড়ে পাকশী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি সদরুল আলম পিন্টুকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে তাকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে অপর গ্রুপের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এ হত্যাকাণ্ডেরও এখনো কোনো বিচার হয়নি।

এসব আলোচিত হত্যাকাণ্ডের রেশ কাটতে না কাটতেই চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি রাতে রূপপুর গ্রামে নিজ বাড়ির সামনে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান সেলিমকে (৬২) দুর্বৃত্তরা গুলি করে হত্যা করে।

মোস্তাফিজুর রহমান সেলিমের স্ত্রী দিলারা বেগম জানান, স্থানীয় প্রভাবশালী চক্র ক্ষমতার জোরে এলাকায় ভুয়া কৃষকের তালিকা তৈরি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। সে তালিকা চ্যালেঞ্জ করে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার কারণে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারে।

আলোচিত এসব হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে পাকশী ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘পাকশী ইউনিয়নে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এলাকার মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।’

পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হবিবুল ইসলাম হব্বুল বলেন, ‘এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং আসামি গ্রেফতার না হওয়ায় আমরাও শঙ্কিত হয়ে পড়েছি।’

পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের আমি নির্দেশ দিয়েছি যত দ্রুত সম্ভব এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার জন্য। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় মানুষের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে।’

সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ঈশ্বরদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বাহাউদ্দিন ফারুকী বলেন, ‘আমি যোগদানের পর মুক্তিযোদ্ধা সেলিমকে হত্যার বিষয়টি ঘটেছে। বাকি পাঁচটি হত্যাকাণ্ডের বিষয় থানার পুরোনো ফাইল ঘেঁটে জেনেছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘পুরনো হত্যাকাণ্ড এবং আওয়ামী লীগ নেতা বীরমুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান সেলিমের হত্যাকাণ্ডের মামলায় জড়িতদের খুব দ্রুতই গ্রেফতার করতে সক্ষম হব। পুলিশ এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে বদ্ধ পরিকর।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর