‘২৫ বৎস্যর (বছর) আগের কথা। তহন আমার বয়স ৯ বৎস্যর। অভাবের লেইগ্যা ইশকুলে যাই নাই। তয় অভাব দূর করনের লেইগ্যা রামগোপালপুর জমিদার বাড়ি থেইক্যা ইট টুক্কাইয়্যা আনতাম। হেরপর হেই ইট ভাইঙ্গা সুরকি করতাম। তহন এক টিন সুরকির দাম আছিন পাঁচ শিকা (১টাকা ২৫ পয়সা)। পরে ওই সুরকি বেচার টেকা জমাইয়্যা নিজেই ইট ভাঙার কারখানা দেই। ইট টুক্কানি বাদ দিয়া ইটভাটা থেইক্যা নয়া ইট কিইন্যা আনি। গেরামের মহিলারা কারখানায় ইট ভাঙে। অহন এক টিন সুরকির দাম ৫৫ টেকা। প্রতি মাসে আমার সুরকি বেইচ্যা ২০ হাজার টেকার মতো লাভ অয়। অহন আর অভাব নাই। স্বামী-সন্তান লইয়্যা আমরা অহন সুখেই আছি।’
বার্তা২৪.কমের কাছে নিজের ইট ভাঙার শ্রমে দিন বদলের গল্পটা এভাবেই তুলে ধরেন ময়মনসিংহের গৌরীপুর পৌর শহরের বালুয়াপাড়া গ্রামের সুরকি ব্যবসায়ী আম্বিয়া খাতুন (৩৪)।
তবে দিন বদলের গল্প এই গল্প শুধু আম্বিয়া খাতুনের নয়। বালুয়াপাড়া গ্রামের প্রায় ২ শতাধিক নারীর পরিবার সংসারের সব কাজ করার পাশাপাশি ইট ভেঙে পরিবারের অভাব দূর করেছেন। নিজেরা উপার্জনক্ষম হয়ে বদলে দিয়েছেন বালুয়াপাড়া গ্রামের জীবন যাত্রা।
গ্রামের প্রবীণ নারী শ্রমিকরা জানান, স্বাধীনতার পর থেকে অভাবের তাড়নায় গ্রামের ৮/১০টি দরিদ্র পরিবারের নারীরা ইট কুঁড়িয়ে এনে সুরকি তৈরি করে বিক্রি করত। এরপর তাদের দেখাদেখি আরও অনেকই জড়িয়ে পড়ে। তবে এখন কেউ ইট কুঁড়ায় না, ইট ভাটা থেকে ইট কিনে আনে। এখন গ্রামের ২০/২৫ টি কারখানায় ২ শতাধিক নারী ইট ভাঙার কাজ করে। ইট ভাঙার কাজ করা নারীদের অনেকেরই এখন আধা-পাকা বাড়ি রয়েছে। অনেকের ঘরে ঘরে আছে, খাট, খাবার টেবিল ও রঙিন টেলিভিশনসহ নানা আসবাবপত্র।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে বালুয়াপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ইট ভাঙা হচ্ছে বাড়ির আঙ্গিনায় বসে। কোথাও আবার ঘরের বারান্দা কিংবা রান্নাঘরের ভেতরেই চলছে ইট ভাঙার কাজ। বিভিন্ন বয়সী নারীরা ইট ভাঙার কাজ করছেন। কোনো স্থানে একা একা, কোনো স্থানে আবার দলবদ্ধ ভাবে। ইট ভাঙার কাজের জন্য নারী শ্রমিকদের ধরাবাঁধা কোন সময় মানতে হয় না। সংসারের অন্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে দিনে-রাতে যখন ইচ্ছা তখন ইট ভাঙে। ইট ভেঙে এক টিন সুরকি করলে পায় ৫ টাকা। প্রতিদিন ১ জন নারী শ্রমিক ইট ভেঙে ২০ থেকে ৩০ টিন পর্যন্ত সুরকি করে।
ইট ভাঙা কারখানার মালিক রাজিয়া খাতুন বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘কারখানার মালিকরা ইট ভাটা থেইক্যা ইট আইন্যা সুরকি বানায়। নারী শ্রমিকরা কারখানায় ১ টিন সুরকি বানাইলে ৫ টেকা পায়। আর আমরা ১ টিন সুরকি ৫০ থেকে ৫৫ টেকা দরে বিক্রি করি। এই ব্যবসা কইর্যা অহন আমার মাসে ২০ হাজার টেকার উফরে লাভ অয়।’
গ্রামের স্থানীয়রা জানান, পুরুষেরা ইজিবাইক চালানো, মুদি দোকান করাসহ নানা পেশায় আছেন। সাথে পুরুষদের রোজগারের পাশাপাশি নারীদের ইট ভাঙা কাজের রোজগার এখন জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন করছে। গ্রামের বেশির ভাগ পরিবারের ছেলে-মেয়েরা এখন স্কুলে যায়।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন গৌরীপুর শাখার সাধারণ সম্পাদক মোঃ রইছ উদ্দিন বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘বালুয়াপাড়া থেকে গৌরীপুর সহ ময়মনসিংহ জেলার আশেপাশের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থাপনা, পাকা ভবন, সড়ক ও বাড়ি নির্মাণের জন্য সুরকি সরবরাহ করা হয়। নারীদের ইট ভাঙার শ্রমে এখন গ্রামের অর্থনৈতিক চিত্রটাই পাল্টে গেছে।’