সিরাজগঞ্জের শাহ্জাদপুরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঐতিহাসিক কাছারিবাড়ি। তিন তৌজির অন্তর্গত ডিহি শাহ্জাদপুরের জমিদারী এক সময় নাটোরের রাণী ভবানীর জমিদারীর একটি অংশ ছিল। ১৮৪০ সালে শাহ্জাদপুরের জমিদারী নিলামে উঠলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৩ টাকা ১০ আনায় এই জমিদারী কিনে নেন।
জমিদারীর সাথে সাথে শাহ্জাদপুরের কাছারি বাড়িটিও ঠাকুর পরিবারের হস্তগত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। ১৮৯০ থেকে ১৮৯৭ পর্যন্ত আট বছর কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শাহ্জাদপুরে জমিদারী দেখাশোনার কাজে মাঝে মাঝে আসতেন, সাময়িকভাবে বসবাস করতেন। তিনি স্থায়ীভাবে থাকতেন কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। সম্ভবত এ কারণেই শিলাইদহের বাড়িটির নাম কুঠিবাড়ি ও শাহ্জাদপুরের বাড়িটি কাছারিবাড়ি নামে পরিচিত।
শাহ্জাদপুরের এ কাছারিবাড়িটি ইন্দো ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত ৩১ দরজা বিশিষ্ট একটি দোতলা ভবন। প্রায় দশ বিঘা জমির উপর নির্মিত ভবনটির দৈর্ঘ্য ২৬ দশমিক ৮৫ মিটার ও প্রস্থ ১০ দশমিক ২০ মিটার এবং উচ্চতায় ৮ দশমিক ৭৪ মিটার। ভবনটির প্রতি তলায় সিঁড়িঘর ব্যতীত বিভিন্ন আকারের সাতটি ঘর রয়েছে। ভবনটির উত্তর-দক্ষিণে একই মাপের বারান্দা। বারান্দায় গোলাকৃতি থামের উপরাংশের অলংকরণ, বড়মাপের দরজা, জানালা ও ছাদের উপরের প্যারাপেট দেয়ালে পোড়ামাটির কাজ বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
ভবনটিতে রবীন্দ্রনাথের জীবনভিত্তিক আলোকচিত্র এবং এ বাড়িতে ব্যবহৃত আসবাবপত্র নিয়ে রবীন্দ্র স্মৃতি জাদুঘর করা হয়েছে। ভবনটির পশ্চিমে বকুল গাছের গোড়ায় বৃত্তাবার সান বাঁধান একটি মঞ্চ আছে। এটি ‘রবীন্দ্র মঞ্চ’ বলে পরিচিত। এখানে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
নিচতলার পশ্চিম দিকের ঘরটিতে ছিল কবির লাইব্রেরি। বর্তমান উত্তর দিকের বারান্দা দিয়ে ঢুকেই প্রথম যে ঘরটি সেখানেই কাচারিবাড়ির লাইব্রেরি। বাড়ির সামনে রয়েছে ফুলের বাগান। পাশে নির্মিত হয়েছে ‘রবীন্দ্র স্মৃতি অডিটরিয়াম’। এতে রয়েছে আধুনিক রীতি সংবলিত ৬০০ আসনের ব্যবস্থা।
শিলাইদহ থেকে শাহ্জাদপুর যাতায়াতের প্রধান উপায় ছিল নৌকা। আর পতিসরেও যাতায়াতের উপায় ছিল ওই একই। পরস্পর দূরে অবস্থিত এ তিনটি জমিদারিতে যোগাযোগের একমাত্র সহজ সূত্র ছিল জনপথ। এ জনপথে যাতায়াতের প্রধান বাহন ছিল জলযান অর্থাৎ নৌকা বা বোট।
কাছারিবাড়ি সংলগ্ন রয়েছে শাহ্জাদপুর বাজার। যেখানে সপ্তাহে রোববার ও বুধবার বাজার বসে। এ দু’দিন সারা দেশ থেকে ব্যবসায়ীরা আসেন তাঁতে বোনানো বিভিন্ন ধরনের কাপড় কিনতে। এ সময় জাদুঘর দেখার সুযোগ কেউ হারান না। সপ্তাহের অন্যান্য দিনের তুলনায় এ দু‘দিন কাছারিবাড়িতে দর্শনার্থীদের চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হয় সংশ্লিষ্টদের।
জাদুঘরটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবহার্য সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে- সোফা, পালকি, ঘুমানোর খাট, চায়ের কেটলি, লনটেনিস খেলার র্যাকেট, খড়ম, চিনামাটির জগ, চিনামাটির পানির ফিল্টার, পিয়ানো, শ্বেত পাথরের গোল টেবিল, চিঠি লেখার ডেস্ক, কাঠের পুজা মণ্ডপ, সোফাসহ বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী। সবচেয়ে আকষর্ণীয় বিষয় ১৩০৭ বঙ্গাব্দের ২৮ ভাদ্র অর্থাৎ প্রায় ১৯০০ সালের লেখা একটি চিঠি জাদুঘরকে সমৃদ্ধ করেছে। চিঠিটি নওগাঁ থেকে সংগৃহীত।
এই চিঠিতে তাঁর পুরো জীবন বৃত্তান্ত পাওয়া যায়। এর উল্লেখযোগ্য অংশ্য হচ্ছে- ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দের ৬ মে কবি জন্মগ্রহণ করেন। ১৬ বছর বয়সে ভারতী পত্রিকার মাধ্যমে গদ্য লেখা শুরু। ১৭ বছর বয়সে তাঁর মেজো দাদার সঙ্গে বিলেতে যান। ২৩ বছর বয়সে তিনি মৃণালিণী দেবীকে বিয়ে করেন। বন্ধু চন্দ্রমজুমদারের বিশেষ অনুরোধ কবি বঙ্গদর্শন পত্রিকা সম্পাদনের ভার গ্রহণ করেছিলেন। তা পাঁচ বছর চালানোর পর এক বছর তিনি ভারতী পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথের বিশেষ রচনাবলীর মধ্যে রয়েছে চারটি কাব্যগ্রন্থ। সোনারতরীতে বৈষ্ণব কবিতা, দুই পাখী, আকাশের চাঁদ, পুরস্কার, হৃদয়, যমুনা, ব্যর্থ যৌবন, ভরা ভাদরে, প্রত্যাখান লজ্জা। চিত্রাতে রয়েছে চিত্রা, শীতে ও বসন্তে, নগর সঙ্গীত। চৈতালীতে রয়েছে নদী যাত্রা, মৃত্যু মাধুরী, স্মৃতি, বিলয়, প্রথম চুম্বন, শেষ চুম্বন, যাত্রী, তৃণ, ঐশ্বর্য, স্বার্থ, প্রেয়সী, শান্তি মন্ত্র, কালিদাসের প্রতি, কুমার সম্ভব গান, মাসসলোক, কাব্য, প্রার্থনা, ইছামতি, নদী, শুশ্রূষা, আশিষ গ্রহণ, বিদায়। কল্পনাতে নব বিরহ, লজ্জিত, বিদায়, হতভাগ্যের গান, কাল্পনিক, যাচনা, সংকোচ, মানস, প্রতিভা। ছোট্টগল্প পোস্টমাষ্টার, রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা, ব্যবধান, তারা প্রসন্নের কীর্তি, ছুটি, সমাপ্তি, ক্ষুধিত পাষাণ, অতিথি। মেয়েলী ছড়া নাটক বির্সজন ও পঞ্চভূত প্রবন্ধের অংশ বিশেষ লিখেছেন। ছিন্নপত্রাবলী রয়েছে ৩৮টি চিঠি।