মুক্তিযোদ্ধা শামসুল ইসলাম। ১৯৫২ সালের ১১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ১৯ বছর। তখন তিনি নোয়াখালীর চৌমুহনী কলেজের বিএ পরীক্ষার্থী। কিন্তু ১৯৭০ এর নির্বাচনের পর থেকে পড়ালেখার চেয়ে বেশি স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন তিনি।
মঙ্গলবার (২৬ মার্চ) বার্তা২৪.কমের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় শামসুল ইসলাম তার মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতিগুলো প্রকাশ করেন।
শামসুল ইসলাম লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার ৮ নম্বর করপাড়া ইউনিয়নের শ্রীপুর গ্রামের মাওলানা আব্দুল আজিজের ছেলে। তার মায়ের নাম নুরুন নাহার। তিনি ৬ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট।
বর্তমানে তিনি লক্ষ্মীপুর পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ড বাঞ্চানগর এলাকার মিয়া বাড়ি সড়কে তার মালিকানাধীন 'মুক্ত বাংলা' নামের বাড়িতে বসবাস করছেন।
শামসুল ইসলাম বলেন, ‘১৯৭০ এর নির্বাচন বাঙালি জাতির জন্য একটি আশীর্বাদ। ওই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আওয়ামী লীগ। তারপরও আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে দেয়নি পশ্চিম পাকিস্তানিরা। তখন বাংলার মানুষ পাকিস্তানিদের টালবাহানায় বুঝে যায় যে, স্বাধীনতা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এর থেকেই বাঙালি জাতি অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে।’
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ছাত্রজীবন থেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। চৌমুহনী কলেজের তৎকালীন সিনিয়র ছাত্রনেতা মাহমুদুর রহমান বেলায়েত, মমিন উল্যা, মোস্তাফিজুর রহমান, মোস্তাফিজুর রহমান লুতু এবং এম আলাউদ্দিনের মতো নেতাদের সংস্পর্শে আন্দোলনে আমাদের স্পৃহা যুগিয়েছে। তাদের নেতৃত্ব ছিল আমাদের আন্দোলনের শক্তি।’
তিনি বলেন, ‘১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদ এবং ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু জনমতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাঙালি জাতিকে চিরতরে নিঃশেষ করার পরিকল্পনা করে। বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণ নেতৃত্বে বাংলার ছাত্র-জনতা, কৃষক-শ্রমিক, সেনা-পুলিশ, ইপিআর-আনসার সকলেই স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। আমি আমার কয়েকজন বন্ধুসহ চৌমুহনী থেকে ঢাকা চলে যাই। সেখানে ২ মার্চ আ স ম আবদুর রব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় স্বাধীনতার প্রথম পতাকা উত্তোলন করেন। ৩ মার্চ শাহাজান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। পরে বাঙালি জাতির মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের জনসমুদ্রে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উপস্থিত হই। ১০-১১ মার্চের দিকে চৌমুহনী চলে আসি।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য কলেজ বন্ধ ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছিল। নেতাদের নির্দেশে কলেজ হোস্টেল থেকে বাড়িতে চলে আসি। তখন এলাকার ছাত্র ও যুব সমাজসহ আমরা শীর্ষ নেতাদের নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলাম। এর সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের চূড়ান্ত প্রস্তুতিও নিতে থাকি। কিন্তু ২৫ মার্চ রাতে ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঘুমন্ত বাঙালি জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু করে গণহত্যা। সেটি ছিল বিশ্বের ইতিহাসে শতাব্দীর নৃশংসতম ঘটনা।'
তিনি বলেন, `বর্বর ওই দিনটি এখনো ভুলতে পারিনি। কখনো সম্ভবও নয়। এখনো এই দিনটি মনে আতঙ্কের জন্ম দেয়। ওইদিন ঝরে যাওয়া সেই প্রাণগুলোর কথা মনে পড়লে চোখ ভিজে যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘সেই ২৫ মার্চ রাতের ঘটনাটি ইতিহাসে অপারেশন সার্চ লাইট হিসেবে পরিচিত। স্বাধীনতার এসব দিনগুলোর কথা বর্তমান প্রজন্মকে জানতে হবে। তবেই তারা আগামীর প্রজন্মকে বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাস সম্পর্কে জানাতে সক্ষম হবে।’
মুক্তিযোদ্ধা শামসুল ইসলাম বলেন, ‘২৫ মার্চ রাতটি ছিল বাঙালি জাতির জন্য অভিশাপ। এক সঙ্গে হাজার হাজার বাঙালিকে গুলি করে ও পুড়িয়ে হত্যা করেছে পাকিস্তানের দোসররা। এটি ইতিহাসের ভয়ানক হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকাণ্ড দেখে আর ঘরে বসে থাকা সম্ভব হয়নি। তখন শুধু একটিই স্বপ্ন ছিল, সেটি হল স্বাধীনতা। চলে গেলাম যুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য।’