একটা সময় যাত্রাপালার মঞ্চে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। নিজের অভিনয় শৈলী দিয়ে ঠাঁই নিয়েছেন দর্শকদের হৃদয়ে। মঞ্চে তার অভিনয় দেখে দর্শকরা হেসেছেন, কখনো কেঁদেছেন, কখনো হয়েছেন আবেগাপ্লুত। কখনো বা তার অভিনয় গুণে মুগ্ধ দর্শক সারিতে বেজে উঠেছে মুহুর্মুহু করতালি। ষাটের দশক থেকে শুরু করে দীর্ঘ চার দশক ধরে অভিনয় করেছেন অসংখ্য যাত্রাপালায়।
অভিনয় জীবনে সুনাম-খ্যাতির পাশাপাশি পেয়েছেন অগণিত দর্শকের ভালোবাসা। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেগুলো আজ শুধুই স্মৃতি বিধবা বীণা রাণী সরকারের (৭৫) কাছে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়া যাত্রাদলের এই গুণী অভিনয় শিল্পী অভাব-অনটনে মানবেতর জীবনযাপন করলেও কেউ খোঁজ খবর নিচ্ছে না। মাঝে মাঝে স্থানীয় যাত্রাশিল্পী ও পরিচিতদের সঙ্গে বীণা রাণীর দেখা হয়, কিন্তু সেটা শুধু নিতান্তই কুশল বিনিময়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাদের কেউ তাকে আর্থিক সহযোগিতা করে না।
বীণা রাণীর বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুর পৌর শহরের গোবিন্দ বাড়ি এলাকায়। তার স্বামী প্রয়াত যাত্রাশিল্পী চিত্তরঞ্জন সরকার। দাম্পত্য জীবনে প্রবীণ এই শিল্পীর কোনো সন্তান নেই। বর্তমানে এক বোনের মেয়ে তাকে দেখভাল করে।
গতকাল বুধবার (২৭ মার্চ) দুপুরে বীণা রাণীর দেখা মিলে গৌরীপুর পৌর শহরের হাতেম আলী রোড এলাকায়। ওই এলাকার একটি পাঠক সংগঠনের কার্যালয়ে বসে বার্তা২৪.কমের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প হয় বীণা রাণীর। বাস্তব জীবনের সেই গল্পগুলোও যেন অনেকটা যাত্রাপালার গল্পের মতোই।
বার্তা২৪.কমকে তিনি বলেন, ‘আমার পৈত্রিক বাড়ি খুলনা জেলায়। অভাবের কারণে পড়াশোনা করা হয়নি। জীবিকার তাগিদে ষাটের দশকে ১৫ বছর বয়সেই যাত্রাপালায় অভিনয় শুরু করি। রাহুগ্রাস নামে একটি যাত্রাপালায় নায়িকা চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে এই জগতে পা রাখি। ওই সময় যাত্রাপালার অভিনয় শিল্পী বায়না করার জন্য ময়মনসিংহের গৌরীপুর থেকে খুলনায় লোক আসত। তখন রঞ্জন অপেরা নামে একটি যাত্রাদলে কাজ করার জন্য বাবা নগেন্দ্র নাথ বর্মণের সঙ্গে গৌরীপুর চলে আসি। স্বাধীনতার কয়েক বছর পূর্বে পারিবারিক ভাবে রঞ্জন অপেরার ম্যানেজার চিত্তরঞ্জন সরকারের সঙ্গে বিয়ে হয়। এরপর থেকে অভিনয়ের পাশাপাশি এখানেই স্থায়ী হয়ে যাই।’
দীর্ঘ অভিনয় জীবনে প্রেয়সী, আনারকলি, কঙ্কাল, ছোট-মা, সিরাজউদ্দৌলা সহ অসংখ্য যাত্রাপালায় অভিনয় করেছেন বীণা রাণী। অভিনয়ের আয়-রোজগারের টাকায় ফিরিয়ে আনেন সংসারে সচ্ছলতা। নব্বই দশকের দিকে অভিনয় থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলেও স্বামী চিত্তরঞ্জন রয়ে যান এই পেশায়। কিন্তু ২০০০ সালে স্বামী মারা যাওয়ার পর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে বীণার। অসহায় হয়ে পড়েন এই প্রবীণ শিল্পী। ২০০৪ সালে পৌরসভা থেকে বয়স্ক ভাতার কার্ড করে দেয়া হয় বীণাকে। এরপর থেকে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে ভাতার টাকাই একমাত্র সম্বল। কিন্তু সামান্য ওই টাকায় তার ভরণ-পোষণ ও চিকিৎসার খরচ চলে না।
বীণা রাণীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে দুপুরের বেলা বিকেলে গড়িয়েছে। তেজ হারিয়েছে সূর্যের আলো। এমন সময় আগমন ঘটে স্থানীয় সাংবাদিক মোস্তাফিজুর রহমান বোরহানের। তিনি বলেন, ‘দিদি আপনার শরীর কেমন?’ জবাবে বীণা রাণী বলেন, ‘বয়সের ভারে চলতে পারি না। ডায়াবেটিসসহ নানা রোগে ভুগছি। এই বয়সে কত কিছু খেতে মন চায়, কিন্তু অভাবের কারণে একবেলার বেশি ভাত খেতে পারি না। ভালো চিকিৎসার জন্য ঋণ করতে মন চায়। কিন্তু আমি মরে গেলে ঋণ পরিশোধ করবে কে? খবরের পাতায় লিখে দিও বীণা রাণী কষ্টে আছে।’
কথাগুলো বলতে বলতেই হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন বীণা। পরক্ষণেই চোখের জল মুছে নিজেকে সামলে হাসতে হাসতে বলেন, ‘বেলা হয়েছে এখন চলে যাব।’ কষ্টের কথা বলতে গিয়ে হাসছেন কেন জানতে চাইলে বীণা রাণী বলেন, ‘এই হাসিটাই তো আমাদের অভিনয়।’