কুড়িগ্রামের চিলমারীতে ঐতিহ্যবাহী নৌ-বন্দর পুনরায় চালুর অপেক্ষায় জেলাবাসী। বন্ধ হয়ে যাওয়া এই বন্দরটি চালু হলে সৃষ্টি হবে নানামুখী কর্মসংস্থান। পাশাপাশি নদীপথে কম খরচে পণ্য আনা-নেওয়া করতে পারবেন ব্যবসায়ীরা।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ভারতের সীমান্ত ঘেষা উত্তরবঙ্গের অন্যতম জেলা কুড়িগ্রামকে এগিয়ে নিতে নানামুখী কর্মসূচি রয়েছে সরকারের। এরই মধ্যে পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করা হয়েছে সোনাহাট স্থল বন্দর। চিলমারী নৌ-বন্দরকে পূর্ণাঙ্গরূপে চালু করার মহাপরিকল্পনা নিয়ে কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র নদ খননের মাধ্যমে নাব্যতা ফিরিয়ে এনে এ নদের সাথে সংযুক্ত সবগুলো নদীর সাথে এমনকি বঙ্গপোসাগরের সাথে চ্যানেল বের করা হবে।
এরপরই পুনরায় চালু করা হবে নৌ-বন্দরটি। এজন্য নৌ মন্ত্রণালয় ভারতের সাথে চুক্তিও সম্পন্ন করেছে। এখন টেন্ডারের অপেক্ষায় আছে। টেন্ডার হয়ে গেলেই শুরু হবে নদের চ্যানেল ঠিক করে নৌ-বন্দর চালুর মহাকর্মযজ্ঞ।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, চিলমারী এক সময় ঐতিহ্যবাহী একটি ব্যবসাকেন্দ্র ছিল। এ স্থানটি অনেক আগে থেকেই ‘চিলমারী বন্দর’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এ বন্দর দিয়ে হাজার হাজার মণ পাট, ধান, চালসহ বিভিন্ন পণ্য নিয়ে বড় বড় জাহাজ চলাচল করতো। ব্রিটিশ আমল থেকেই কলকাতা-গৌহাটি এবং আসামের ধুবড়ি পর্যন্ত নৌ-যাতায়াত ছিল। বন্দরটিকে ঘিরে চিলমারীতে গড়ে উঠেছিল বড় বড় পাটের, সরিষার, ধানের, গমের, বাদামের, তিসির ও ভুট্টার গোডাউন।
দেশের নামিদামি পাট কোম্পানিগুলো চিলমারীতে এসে অফিস খুলে পাট ক্রয় করতো। এছাড়া বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা এসে বিভিন্ন ধরনের মালামাল ক্রয় করার জন্য দিনের পর দিন অবস্থান করতেন। সে সময় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এখানে পাইলট বিট ও এসএসবি স্টেশন স্থাপন করে।
তবে নদী ভাঙন এবং নাব্যতা সংকটের কারণে চিলমারী কেন্দ্রিক অভ্যন্তরীণ ব্যবসা বাণিজ্যিক কার্যক্রম ক্রমেই বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এই চিলমারী নদীবন্দরটি ছিল পায়রা সমুদ্র বন্দর থেকে নৌপথে ভারত, ভুটান ও নেপালের মধ্যে আঞ্চলিক যোগাযোগের একমাত্র নৌ-রুট। এ কারণে চিলমারী নদীবন্দরের উন্নয়ন করা হলে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে কুড়িগ্রামের উন্নয়নের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে।
২০১৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুড়িগ্রামের চিলমারী সফরে এসে এক জনসভায় চিলমারীকে নৌ-বন্দর হিসেবে ঘোষণা করেন। ওই বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর চিলমারীর রমনা শ্যালোঘাট নামক স্থানে পল্টুন স্থাপন করে বিআইডব্লিউটিএ’র নদীবন্দর উদ্বোধন করেন তৎকালীন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। বন্দরটির উন্নয়নে নেওয়া হয় বেশ কিছু প্রকল্প।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর থেকে পুনরায় বন্দরটি চালুর স্বপ্ন দেখছেন স্থানীয় শ্রমিক কথা সাধারণ মানুষ। কেননা বর্তমানে নদের নাব্যতা সংকটে কিছু শ্যালোনৌকা শুধু চিলমারী ঘাট থেকে রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলা ঘাট পর্যন্ত আসা যাওয়া করছে। এতেই কুলির কাজ করে কোনো রকম জীবনধারণ করছেন শ্রমিকরা। নৌ-বন্দর চালু হলে বড় বড় পণ্য নিয়ে বড় বড় জাহাজ ভিড়বে এই বন্দরে, তখন আর কাজের অভাব থাকবে না তাদের।
চিলমারী নৌ-বন্দর খ্যাত বর্তমান রমনা শ্যালোঘাটে কাজ করা শ্রমিক সফিকুল ইসলাম (৫৫) বলেন, আজ থেকে ১৫/১৬ বছর আগেও এই বন্দরে পাট বোঝাই, পণ্য বোঝাই জাহাজ ভিড়তো। তখনও আমরা এই বন্দরে শ্রমিকের কাজ করতাম। কিন্তু দিনে দিনে নদ শুকিয়ে যাওয়ায় পণ্য বোঝাই জাহাজ আর ভিড়তে পারে না। ডুবোচরে আটকে যায়। এজন্য বন্দরটি অচল হয়ে পড়ে।
শ্রমিক সবজাল (৬০) ও আব্দুর রহমান (৫৮) বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর থেকেই আমরা অপেক্ষায় আছি, কখন বন্দরটি চালু হবে। বর্তমানে ঘাটে নৌকায় মোটরসাইকেল ওঠানো-নামানো আর দু’একটি বস্তা ছাড়া আর কোনো মালামাল ওঠানো-নামানো করতে পারছি না। বন্দর চালু হলে জাহাজ ভিড়বে, তখন আর কাজের অভাব হবে না। আমরা চাই, যেহেতু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বন্দর চালুর ঘোষণা দিয়েছেন; তারাতাড়ি যেন এই বন্দর চালু হয়।
স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. মহসিন আলী জানান, চিলমারী নৌ-বন্দর চালু হলে এ জেলার ব্যবসা বাণিজ্যে আমূল পরিবর্তন আসবে। কেননা সড়ক পথে মাল আনা-নেওয়া করতে বেশি খরচ পড়ে; কিন্তু বন্দরের কার্যক্রম শুরু হলে খরচও কমবে, সময়ও বাঁচবে। এতে ব্যবসায়ীরা লাভবান হওয়ার পাশাপাশি ক্রেতারাও সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য ক্রয় করতে পারবেন।
চিলমারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত আলী বীর বিক্রম জানান, এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী চিলমারী নৌ-বন্দর তার যে নাম ডাক ছড়িয়েছিল, কালের বিবর্তনে তা হারিয়ে গেলেও বন্দরটি পুনরায় চালু হলে বিভিন্ন নৌ-রুটে এই বন্দরে সহজে পণ্য আনা-নেওয়া করা সহজ হবে। এতে জেলার মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে।
এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএ’র যুগ্ম পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বার্তা২৪.কমকে জানান, ইতোমধ্যে বন্দরটির উন্নয়নে প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। অতি শিগগিরই নদী ডেজিংয়ের কাজ শুরু হবে। সাথে সাথে নদী বন্দরের কার্যক্রমও শুরু হবে।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীন জানান, ব্রহ্মপুত্র নদ খননসহ চিলমারী নৌ-বন্দর চালুর জন্য মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে নদের চ্যানেলগুলোর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে ভারতের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এখন এটি টেন্ডারের অপেক্ষায় আছে। টেন্ডার হয়ে গেলেই খননের কার্যক্রম শুরু হবে।