মাকে না জানিয়েই স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিতে ভারতে প্রশিক্ষণে গিয়েছিলেন লক্ষ্মীপুরের মুক্তিযোদ্ধা শামসুল ইসলাম। নিয়েছেন গ্রেনেড চার্জ, এসএমজি, এলএমজি, এমজি ও এসএলআর এ ধরণের অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ শেষে ফেনীর সালদা নদী পার হয়ে বেলুনিয়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেন। তারপর জুলাই মাসে প্রবেশ করেন দেশে।
সম্প্রতি বার্তা২৪.কম’র সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি এসব কথা জানান।
শামসুল ইসলাম বলেন, ‘১৯৭১ সালে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল ছিলাম। লক্ষ্মীপুরের বশিকপুরের আবদুল ওয়াহেদ এবং চৌমুহনী কলেজের ছাত্রনেতা শাহ আলম চৌধুরী আমাদের প্রশিক্ষণে যাওয়ার নির্দেশ দেন। পরে ১১ মে পোদ্দার বাজার থেকে আমরা ২৫ জন ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। ওইদিন আমি আমার ভাতিজা কাজলকে বলেছিলাম। আব্বা জানতেন আমি যুদ্ধে যাব। কিন্তু মা যেতে দেবেন না বলে তাকে আর বলে যাইনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘যাওয়ার সময় সোমপাড়া গিয়ে কবি নজরুল কলেজের ছাত্রনেতা সিরাজ-উদ-দৌলার বাড়িতে সবাই সঙ্গবদ্ধ হই। সেখানে স্বাধীনতাকামী আরো ৭০-৮০ জন ছাত্রজনতাকে পেয়ে সাহস বেড়ে গিয়েছিল। অজান্তে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল মন। দিনটি কোনো রকম কাটিয়ে রাতের আঁধারে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। বজরা অতিক্রম করে ওয়াছেদপুর আসতে সকাল হয়ে যায়। সেখানে চৌমুহনী কলেজের ছাত্রনেতা মনির আহমেদ চৌধুরী আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করেন। আবার সন্ধ্যায় যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু কানকির হাট পৌঁছানোর আগেই বৃষ্টি শুরু হলে পাশের ছোট্ট কাচারি ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। পরের দিন সন্ধ্যায় আর্মিদের টহল ফাঁকি দিয়ে দু’জন দু’জন করে চৌদ্দগ্রাম সীমান্তপথ পাড়ি দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিলাম।’
এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘ভারতের ছোত্তাখোলা ট্রানজিট ক্যাম্প ইনচার্জ খাজা আহমেদ ওরফে খাজু মিয়া আমাদের স্বাগত জানিয়েছিলেন। সেখান থেকে রাজনগর টাকিয়াটিলা ক্যাম্পে এক সপ্তাহ অবস্থান করি। তারপর উদয়পুর পালাটানা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে চলে যাই। সেখানে এক হাজার প্রশিক্ষণার্থীর মধ্যে লক্ষ্মীপুরের প্রায় ৩০০ জন যোদ্ধা ছিলেন। ক্যাপ্টেন সুজ্জাত আলী এবং ভারতের ক্যাপ্টেন ভিপি ধরের তত্ত্বাবধায়নে আমাদের প্রশিক্ষণ শেষ হয়। এ সময় গ্রেনেড চার্জ, এসএমজি, এলএমজি, এমজি ও এসএলআর এ ধরনের অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।’
যুদ্ধে অংশ নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রশিক্ষণ শেষে ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে ফেনীর সালদা নদী পার হয়ে বেলুনিয়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করি। তারপর জুলাই মাসে আমরা দেশে প্রবেশ করি। গুণবতী নদী পার হওয়ার সময় পা পিছলে আমাদের এক সহযোদ্ধা পড়ে যান। তাৎক্ষণিক তার পিস্তল থেকে ফায়ারিং হয়ে যায়। ওই রেঞ্জের ভেতরে ছিল হানাদারদের ক্যাম্প। মুহূর্তে তারা সজাগ হয়ে যায়। তারপর আমরা নৌকায় নদী পার না হয়ে, সাঁতরে পার হয়েছিলাম।’
তিনি আরও বলেন, ‘বৃহত্তর নোয়াখালীর নেতাদের নির্দেশে আমরা লক্ষ্মীপুরে চলে আসি। আমাদের যুদ্ধের এলাকা ছিল- চাটখিল, সোমপাড়া, খীলপাড়া, মল্লিকার দিঘীরপাড়, করপাড়া, লামচর, বদরপুর শ্রীপুর, বশিকপুর, পোদ্দার বাজার, মাঝিরগাঁও, শ্যামগঞ্জ, নোয়াহাট, সমিতির হাট ও রায়পুরসহ বিস্তৃর্ণ এলাকা। যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা এখানেই দায়িত্বে ছিলাম। সুবেদার লুৎফুর রহমান, তৎকালীন বিজয়নগর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রয়াত রফিকুল হায়দার চৌধুরী, বিএলএফ নোয়াখালী জেলা অধিনায়ক মাহমুদুর রহমান বেলায়েত, একরামুল হক, ছাত্রনেতা ও বিএলএফ থানা অধিনায়ক আ ও ম শফী, বিএলএফ থানা সহ-অধিনায়ক জয়নাল আবেদীন আমাদের নেতৃত্বে ছিলেন। এরমধ্যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে আমাদের অনেকেই শহীদ হন।’