‘জামাইর (স্বামী) ঘর বেশিদিন করা অইলো না। ভাবছিলাম পোলাপাইনে আমারে খাওন-খোরাকি দিবো। অভাবের ঠেলায় তো ওরাই নিজের সংসার চালাইতে পারেনা। আমারে কি খাওয়াইবো। কপালডা ভালা এই বইল্যা যে, অভাবের মধ্যেও ছোট পোলা সবদূর আমারে খাওয়ায়। ওর লগেই আমি থাহি (থাকি)।
তয় আমার বয়স অইছে, খাটাখাটনি করবার পারিনা, শইলেও মেলা অসুখ-বিসুখ ধরছে। টেকার অভাবে ভালা ডাক্তারও দেহাইতে পারিনা। মাইনসের কাছে হুনি বুড়া অইলে, স্বামী মরলে সরকারে বলে ভাতার কার্ড দেয়। কই আমি তো বুড়া থুরথুরা অইয়া গেছি। আমারে তো কেউ ভাতার কার্ড দিল না’।
বার্তা২৪.কমের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন ৮২ বছরের বিধবা বৃদ্ধা জহুরান্নেছা। তার বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলারা ২নং গৌরীপুর ইউনিয়নের শালীহর গ্রামে। স্বামী-মৃত উমর আলী।
বুধবার সকাল সাড়ে ১১টায় জহুরেন্নাছার দেখা মেলে গৌরীপুর পৌর শহরের পাটবাজার এলাকায়। বয়সের ভারে তার কোমর বেঁকে গেছে। কুঁচকে গেছে গায়ের চামড়া। এই শরীরেই হাতে একটি ব্যাগ নিয়ে ধীর গতিতে হেঁটে চলছেন তিনি। হঠাৎ ওই এলাকার চায়ের দোকানে বসে থাকা কাস্টমারদের কাছে সাহায্যের আকুতি জানালেন তিনি। সাহায্য করার সূত্র ধরেই এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় এই বৃদ্ধার।
বার্তা২৪.কমকে তিনি বলেন, সংগ্রামের (মুক্তিযুদ্ধ) আগেই আমার বিয়া অয়। সংসারে আহে চাইর পোলা ও এক মাইয়া। জামাই (স্বামী) তহন কাঁচাবজারের ব্যবসা কইর্যা সংসার চালাইতো। অভাব থাকলেও সংসারডাত সুখ আছিল। হুট কইর্যা জামাই আরেকটা বিয়া করনে আমি ওইহান থেইক্যা আইয়া পড়ি। হেরপর কষ্ট কইর্যা পোলপাইনডিরে বড় করছি। তয় সংসারের অভাব আর দূর অইলো না। অহন বুইর্যা বয়সেও মাইনসের কাছে হাত পাতন লাগে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শালীহর গ্রামের একটি জরাজীর্ণ ঘরে জহুরেন্নাছা বসবাস করেন। তার স্বামী মারা গেছে প্রায় ২০ বছর আগে। চার ছেলে ও এক মেয়ের সবারই বিয়ে হয়ে গেছে। তবে ছোট ছেলে সবদূর ছাড়া কেউ মায়ের খোজঁ-খবর নেয় না। বয়সের ভাড়ে ন্যুয়ে পড়া জহুরান্নেসার বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছেন। প্রতিমাসে তার ওষুধ বাবদ এক হাজার টাকার বেশি খরচ অয়। মানুষের কাছ থেকে সাহায্য নিয়েই তিনি খরচটা জোগান।
জহুরেন্নাছার বয়স ৮২ হলেও তিনি কোনো বয়স্ক ভাতা পান না। জরাজীর্ণ ঘরে থাকলেও সরকারি ঘরের বরাদ্দ তার ভাগ্য জোটেনি। একবার স্থানীয় ইউপি সদস্য বয়স্ক ভাতা দেয়ার কথা বলে জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবি নিলেও পরবর্তীতে তিনি ভাতা পাননি। তবে গ্রামের মানুষ ধান কাটার মওসুমে তাকে ধান-চাল দিয়ে সাহায্য করে। সেটা দিয়েই কষ্ট করে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন তিনি।
বার্তা২৪.কমকে জহুরান্নেছা বলেন ‘যারার (যার) লোক আছে, হেরা ভাতার কার্ড পাইছে। আমার লোকও নাই। ভাতার কার্ডও নাই। গেরামের মেম্বাররে জিগাইলে খালি কয় অইবো। কিন্তু কবে যে অইবো হেইডা আর কয় না। কার্ডটা পাইলে তো একটু অইলেও আমার অভাবডা কমতো। এই বয়সে কত কিছু খাইতে-পড়তে মন চায়। তয় সব কিছুর লেইগ্যা মাইনষ্যের কাছে হাত পাততে ভাল্লাগে না।’
জহুরান্নেছার সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঘড়ির কাটায় ১২টা বেজেছে। চায়ের দোকানটা তখন অনেকটাই কাস্টমার শূন্য। এমন সময় কাছে এসে বসেন চা দোকানি হারুন রশিদ। তিনি বলেন, চাচি এই বয়সে তুমি ভাতা পাওনা আমার তো বিশ্বাস হয় না। সত্য করে বলেন, সাংবাদিকের কাছে মিছা (মিথ্যা) কথা কইলে কিন্তু ধরা খাইবা।
জহুরান্নেছার সোঁজা জবাব, এই বয়সে মিছা কথা কইলে বাবা, মরার পরে আমারে মাইট্যে গছতো না”।