সম্ভাবনামার নতুন দ্বার দেশের সর্ব উত্তরের সোনাহাট স্থলবন্দর। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সাতটি অঙ্গ রাজ্যের সড়ক পথে পণ্য পরিবহনের সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে এ বন্দরটি। সোনাহাট স্থলবন্দর ব্যবহার করে ভারতের আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম, মনিপুর, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা ও অরুনাচল রাজ্যের সঙ্গে সড়ক পথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। ভারত থেকে আমদানি পণ্য পরিবহনে ৪০০ কিলোমিটার পথ সাশ্রয় হওয়ায় লাভবান হবেন দু’দেশের ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি পর্যটন ও পারস্পরিক সর্ম্পক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখবে।
উত্তরের সীমান্ত ঘেষা জেলা কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলার বঙ্গসোনাহাট ইউনিয়নের বানুরকুটি গ্রামে আন্তর্জাতিক সীমানা পিলারের (পিলার নং-১০০৯) কাছে এ বন্দর অবস্থিত। এটি ব্রিটিশ আমলে একটি বাণিজ্যিক বন্দর ও একটি সমৃদ্ধ শহর ছিল। ওই সময় বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের আসাম, মিজোরাম, মনিপুর, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, অরুনাচল ও মেঘালয় রাজ্যের একমাত্র প্রবেশদ্বার ছিল এ বন্দরটি। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর এ পথগুলো বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে আসে এ বন্দরের সকল প্রকার কার্যক্রম।
পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ আইন ২০০১ (২০০১ সালের ২০ নং আইন) এর ধারা ৩ অনুয়ায়ী সরকার ২০০৯ সালের ১১ জুন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রজ্ঞাপন (নং ২৬২/২০০৮) দ্বারা ঘোষিত সোনাহাট শুল্ক স্টেশনকে পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর ঘোষণা করা হয়। এর আগে ১৯৯৫ সালে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ সোনাহাট স্থল শুল্ক স্টেশন স্থাপনের প্রজ্ঞাপন জারি করে। ১৯৯৬ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বঙ্গসোনাহাট স্থলবন্দরকে ল্যান্ড পোস্ট হিসেবে ঘোষণা করে।
এ বন্দরে ১৪ দশমিক ৬৮ একর জমির উপর ৬০ মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতার একটি ওয়ার হাউস, ৯৬ হাজার বর্গফুট আয়তনের পার্কিং ইয়ার্ড, ৮৫ হাজার বর্গফুট আয়তনের ওপেন স্ট্যাক ইয়ার্ড, শ্রমিকদের জন্য দুটি বিশ্রামাগার, একটি প্রশাসনিক ভবন, সিকিউরিটি ব্যারাক, ডরমেটরি ভবনসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ব্যয় হয় ৩৯ কোটি ৪৩ লাখ ২৬ হাজার টাকা। এই বন্দর দিয়ে পাথর, কয়লা, তাজা ফল, ভূট্টা, গম, চাল, ডাল, রসুন, আদা ও পিঁয়াজসহ ১০টি পণ্য আমদানি এবং বিধি অনুযায়ী সব ধরনের বৈধ্য পণ্য রফতানি করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত শুধু মাত্র কয়লা ও পাথর আমদানি করছেন বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা।
২০১৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলায় সোনাহাট স্থল বন্দর চালু করা হয়। সে আলোকে জেলা শহর থেকে বন্দর পর্যন্ত সড়ক পথ সম্প্রসারণ করা হলেও দুধকুমার নদীর উপর ব্রিটিশ আমলে নির্মিত সোনাহাট রেল সেতুর স্থায়িত্ব শেষ হওয়ায় এর উপর দিয়ে ভারী যান চলাচল করতে পারে না। বিভিন্ন সময় সেতুর পাটাতন ভেঙে বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল।
সোনাহাট স্থল বন্দর সিএন্ডএফ সভাপতি সরকার রাকিব আহমেদ জুয়েল বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘বন্দর সচল রাখতে সড়ক পথ ভালো রাখার কোনো বিকল্প নাই। আর সে ক্ষেত্রে সোনাহাট সেতু এখন রীতিমত বন্দর ব্যবসায়ীর জন্য অভিশাপে পরিণত হয়েছে। তবে আশার কথা সম্প্রতি একনেক সভায় সরকার সোনাহাট সেতুর নির্মাণ প্রকল্প পাশ করেছে। আমরা চাই দ্রুতই তা বাস্তবায়ন করে বন্দরের যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল রাখবে।’
সোনাহাট স্থল বন্দর আমদানি-রফতানি কারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক বার্তা২৪কমকে বলেন, ‘এই বন্দরটি চালু করার পর অনেক আশা নিয়ে আমরা ব্যবসা শুরু করি। এরপর দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা এখানে আসা শুরু করে। কিন্তু ভারতীয় প্রশাসনের সঠিক নজরদারির অভাবে এলসি করেও কয়লা ও পাথরের জন্য অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘ সময়। এতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে এ বন্দর দিয়ে প্রতিদিন ১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন পাথর ও কয়লা ভারত থেকে আমদানি হয়। এতে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় হয়।’
সোনাহাট স্থলবন্দর হ্যান্ডেলিং শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. হামিদুল ইসলাম বার্তা২৪.কমকে জানান, বন্দরটি চালু হওয়ার পর এই অঞ্চলের প্রায় ২ হাজার অভাবী মানুষজন বন্দরে লোড-আনলোডের কাজসহ অন্যান্য কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। ভারতীয় নানা সমস্যায় বিভিন্ন সময় ১৫দিন থেকে এক মাস পর্যন্ত পণ্য আমদানি বন্ধ থাকে। এতে করে বিপাকে পড়ে যান বন্দরের শ্রমিকরা।
সোনাহাট স্থল বন্দর কর্তৃপক্ষের ওয়্যার হাউস ইনচার্জ মাহফুজুল হক ভুইয়া বার্তা২৪.কমকে জানান, এই বন্দরে ওয়ার হাউস, পার্কিং ডক ইয়ার্ডসহ সকল অবকাঠামো আমাদের প্রস্তুত রয়েছে। পণ্য আমদানি রফতানির সংখ্যা বাড়লে সরকারের রাজস্বের পাশাপাশি সকল ক্ষেত্রে লাভবান হবেন বন্দরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) দুপুরে বাংলাদেশে তৈরি প্লাস্টিক পণ্য রফতানির মাধ্যমে প্রথমবারের মতো সোনাহাট স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য রফতানির কার্যক্রম শুরু হয়।
সোনাহাট স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, সোনাহাট স্থলবন্দর চালু হওয়ার পর ভারত থেকে পাথর ও কয়লা আমদানি চলমান ছিল। তবে এতদিন বাংলাদেশ থেকে কোন পণ্য ভারতে রফতানি করা হয়নি। বৃহস্পতিবার প্রথমবারের মতো বাংলাদেশি পণ্য রফতানির মাধ্যমে এ স্থবিরতার অবসান হলো।