বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের মৃত্যুবার্ষিকী শনিবার

ফরিদপুর, দেশের খবর

রেজাউল করিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, ফরিদপুর, বার্তা ২৪.কম | 2023-09-01 01:50:01

শহীদ ল্যান্স নায়েক বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের ৪৮তম শাহাদাত বার্ষিকী শনিবার। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ২০ এপ্রিল রাঙামাটির মহালছড়িতে পাক হানাদারদের ছোড়া মর্টারের গোলায় বাংলা মায়ের এই বীর সন্তান শাহাদাত বরণ করেন।

ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ তার কোম্পানির মেশিনগানার হিসেবে রাঙামাটি-মহালছড়ি বুড়িঘাটা নৌপথে গুরুত্বপূর্ণ পোস্টে দায়িত্বরত ছিলেন। পাক হানাদারদের মর্টার ও ভারী অস্ত্রের প্রচণ্ড গোলা বর্ষণের মুখে সেদিন মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।

এই অবস্থায় তার সঙ্গী যোদ্ধারা বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যান এদিক-সেদিক। ওই ভয়াবহ কঠিন পরিস্থিতির মুখেও একমাত্র ল্যান্স নায়েক রউফ তাঁর নিজের অবস্থানে থেকে মেশিনগানের মুহুর্মুহু ব্রাশ ফায়ারে শত্রুদের পাল্টা জবাব দিতে থাকেন। একপর্যায়ে পাকি হানাদারদের দু‘টি লঞ্চ ও একটি স্পিডবোট পানিতে ডুবে যায় এবং দুই প্লাটুন শত্রু সৈন্য সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়।

এ সময় হঠাৎ করেই শত্রুর মর্টারের একটি গোলা তাঁকে আঘাত করলে তিনি ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। পরে রাঙামাটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলার চিংড়িখালের পাড়ে তাকে সমাহিত করা হয়।

মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরসেনানী বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ ১৯৪৩ সালের ১ মে ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার কামারখালীর মধুমতি নদীর তীরের ছোট্ট গ্রাম সালামতপুরে জন্মগ্রহণ করেন।

যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর অদম্য সাহস, কর্তব্য পরায়ণতা, দৃঢ়সংকল্প দেশ প্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মুক্তিযুদ্ধে বীরোচিত ভূমিকা ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করে।

তাঁর পিতার নাম মুন্সী মেহেদী হাসান। তিন ভাই বোনের মধ্যে রউফ ছিলেন সবার বড়। বাবা মেহেদী হাসান স্থানীয় একটি মসজিদে ইমামতি করতেন। মাত্র ১১ বছর বয়সে পিতাকে হারান। আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে ছেলের লেখাপড়া বেশিদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি তিনি। ফলে কামারখালী হাই স্কুলে নবম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় আব্দুর রউফ ১৯৬৩ সালে তৎকালীন ইপিআর (বর্তমান বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) এ যোগ দেন। তার সৈনিক নম্বর ছিল ১৩১৮৭। ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি অষ্টম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হন এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।

ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ শহীদ হবার দীর্ঘ ২৫ বছর পর ১৯৯৬ সালে বুড়িঘাট নিবাসী জ্যোতিষ চন্দ্র চাকমা ও দয়াল কৃঞ্চ চাকমার সহায়তায় বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ এর কবরের স্থান সনাক্ত করতে সক্ষম হন। ১৯৯৭ সালে সেখানে একটি স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করা হয়।

বিগত ২০০৮ সালে ২৮ মে তার নিজ গ্রাম সালামাতপুরের নাম রউফ নগর রাখা হয়। ওই বছরেই তাঁর নামে নিজ গ্রাম রউফ নগরে স্থানীয় সরকার সমবায় মন্ত্রণালয় ফরিদপুর জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে প্রায় ৬৮ লক্ষ টাকা ব্যয়ে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ স্মৃতি যাদুঘর ও গ্রন্থাগার নির্মাণ করা হয়েছে।

তাঁর শাহাদাত বার্ষিকীতে নিজ গ্রাম ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার সালামতপুরে (বর্তমানে রউফ নগর) নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে পরিবার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে। ৪৩ বছর বুকে স্মৃতি ধরে বেঁচে থাকা মা ২০১৪ সালের ২২ মে মৃত্যুবরণ করেন।
বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত এ যোদ্ধার জন্মস্থানকে ঘিরে স্থানীয়দের চাওয়া পাওয়ার অনেকটাই এখনো পূরণ হয়নি। জেলার মধুখালী উপজেলার মধুমতি নদীর কোল ঘেঁষে সামনের দিকে এগোলেই অবহেলিত এক জনপদ সালামতপুর গ্রাম।

একমাত্র কামারখালীতে সম্প্রতি স্থাপিত বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফ ডিগ্রি কলেজের নামকরণ করা ছাড়া আর কোন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা তার নামে নাম করণ করা হয়নি বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।

জানাগেছে, বীরমাতা বেঁচে থাকতে কয়েক বছর আগে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করে কামারখালীকে বীরশ্রেষ্ঠের নামে আলাদা উপজেলা গঠনের দাবি জানালে প্রধানমন্ত্রী তা বিবেচনায় নিলেও এখনো তা কাগজপত্র চালাচালির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে।

এদিকে আধুনিক সভ্যতার যুগে এখনো বীরশ্রেষ্ঠ গ্রাম সালামতপুরে আজও পৌঁছেনি বিদ্যুৎ কিংবা পাকা সড়ক।

মধুখালীর কামারখালী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোঃ লুৎফর রহমান বলেন, ‘সালামতপুর গ্রামে সরকারীভাবে গড়ে তোলা বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফ স্মৃতি যাদুঘর ও পাঠাগারটিতে বিদ্যুৎ না থাকায় পাঠক আসছেনা।’
তিনি বলেন, ‘পাঠাগারে যাতায়াতের রাস্তার একটি অংশ মধুমতি নদী ভাঙনের মুখে পড়েছে।’

সম্প্রতি সরকারি হওয়া বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফ ডিগ্রী কলেজ শিক্ষক মোঃ সাদিকুর রহমান জোয়াদ্দার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এ জাতীয় বীরের মৃত্যুবার্ষিকীর আয়োজন ততোটা বড় নয়। সরকারের পক্ষ থেকে বড় আয়োজন থাকা দরকার ছিল।’

তিনি বলেন, ‘যে কোন বীরশ্রেষ্ঠের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী জাতীয়ভাবে পালন করলে দেশের মুখ আরও উজ্জ্বল হবে।’

মধুখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তফা মনোয়ার জানান, মুন্সী আব্দুর রউফের ৪৮তম শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে রউফ নগরের (সালামাতপুর) গ্রামে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে তার স্মৃতি ফলকে পুষ্পমাল্য অর্পণ, জাতীয় পতাকা উত্তোলনসহ যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে এবং স্মৃতি সংসদ ও পারিবারিক উদ্যোগে কোরআন তিলাওয়াত ও আলোচনা সভা এবং বাদ জোহর মিলাদ মাহফিল ও দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। এর জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা তাঁর বড় বোনকে দেওয়া হয়েছে।

বীরশ্রেষ্ঠ‘র বড় বোন জাহানারা বেগম জানান, বীরমাতা মুকিদুননেছা মৃত্যুর পর পরিবারের পক্ষ থেকে এবং উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় আমরা সালামাতপুরে আলোচনা ও দোয়া এবং মিলাদ মাহফিল আয়োজন করি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর