‘নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে লাশের গোসলের জন্য একজন ইমাম আনা হয়। কাউন্সিলর নজরুলের বিকৃত দেহ দেখে ইমাম সাহেব গোসল করাতে ভয় পান। সিদ্ধান্ত হয় ইমাম সাহেব দেখিয়ে দেবেন আর আমি ও কাউন্সিলর কামরুল ইসলাম মুন্না গোসল করাব। যথারীতি আমরা দুইজন হাতে গ্লাভস পরে নজরুলকে গোসল করাই। গোসলের সময় নজরুলের মাংস আমাদের হাতে উঠে আসে, সেই কী ভয়াবহ দৃশ্য। না দেখলে বোঝার উপায় নেই। গোসল শেষে জানাজার জন্য কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের লাশবাহী কফিন নগর ভবনের গেটে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথম জানাজা শেষে লাশ নিয়ে রাখি খানপুরের ৩০০ শয্যা হাসপাতালের হিমাগারে।’
শনিবার (২৭ এপ্রিল) দুপুরে এভাবেই বার্তা২৪.কমের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলোচিত সাত খুনের ঘটনার স্মৃতিচারণ করছিলেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ ৭ জন অপহরণ ও ৪ দিনপর শীতলক্ষ্যা নদীতে সরেজমিনে লাশ দেখে ছিলেন তিনি।
কাউন্সিলর খোরশেদ বলেন, ‘এখনো সেই স্মৃতি মনে করলে শরীরের লোম শিউরে ওঠে। খুব ভয়ানক ছিল সেদিন। আমরা চাই অবিলম্বে সাজাপ্রাপ্তদের দ্রুত রায় কার্যকর করা হোক।’
নারায়ণগঞ্জবাসীর ললাটে কলঙ্ক এঁটে দেয়া আলোচিত সাত খুনের নৃশংসতা শুধু এই জেলাবাসীকেই নয় পুরো বিশ্ববাসীকেও নাড়া দিয়েছিল। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও আলোচিত ছিল ৭ খুনের ইস্যুটি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এলিট ফোর্স র্যাব সদস্যদের সম্পৃক্ততায় নারায়ণগঞ্জের ইতিহাসে তো বটেই দেশের ইতিহাসেও ন্যাক্কারজনক ঘটনার একটিতে পরিণত হয়েছিল ৭ খুনের ঘটনাটি। তবে আলোচিত ওই হত্যাকাণ্ডের ৫ বছর পূর্ণ হলেও অদ্যাবধি হত্যাকাণ্ডের রায় বাস্তবায়ন হয়নি। নিম্ন আদালতের পরে হাইকোর্টেও দ্রুত রায় ঘোষণা করা হয়। তবে আপিল বিভাগে রায়টি নিষ্পত্তি হতে সময় নিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন নিহতের স্বজনরা।
নজরুলের গাড়িচালক নিহত জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী নুপুর বলেন, ‘৫ বছর হয়ে গেল এখনো খুনিদের ফাঁসি হলো না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হয় এ খুনিদের ফাঁসি দেয়া হোক।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার মেয়ে রওজার বয়স সাড়ে ৪ বছর। ও সারাক্ষণ ‘আব্বু আব্বু’ বলে ডাকে। আমি কষ্ট করি কিন্তু মেয়েটাকে কষ্ট দিতে চাই না। সিটি করপোরেশনে যে চাকরি করছি সেটা অস্থায়ী হিসেবে বেতন ৬ হাজার টাকা। সরকার যদি চাকরিটা সরকারি করে দেয় তাহলে খুব উপকার হয়। মেয়েটাকে নিয়ে খুব কষ্ট করেই সংসার চলাতে হচ্ছে।’
এদিকে ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল অপহরণের সেই ঘটনা এখনো ভুলতে পারেনি রাজধানীর পাশে শীতলক্ষ্যা তীরের মানুষ।
জানা গেছে, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের একটি আদালতে হাজিরা শেষে প্রাইভেটকারযোগে ফিরছিলেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন ও গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম। একই সময়ে আদালতের কার্যক্রম শেষে অপর একটি প্রাইভেটকারে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহীম।
পথিমধ্যে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের সামনে থেকে সাদা পোশাক পরিহিত র্যাব সদস্যরা তাদের ৭ জনকেই অপহরণ করে। ৭ জনকে অপহরণের ঘটনায় উত্তাল হয়ে উঠে নারায়ণগঞ্জ। দফায় দফায় চলতে থাকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড অবরোধ।
পরে ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীর চর ধলেশ্বরী এলাকা থেকে ছয়জনের ও ১ মে একজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ৭ জনকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একই পন্থা ও কায়দা অবলম্বন করা হয়। নিহতদের মধ্যে সবাইকে একই স্টাইলে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়া হয়। যাতে করে লাশ ভেসে উঠতে না পারে। উদ্ধার করা লাশের সবারই হাত-পা বাঁধা ছিল, পেটও কাটা ছিল। ১২টি করে ইট ভর্তি সিমেন্টের বস্তার দুটি বস্তা বেঁধে দেয়া হয় প্রতিটি লাশের সঙ্গে। তাদের সবার লাশের মুখ ছিল ডাবল পলিথিন দিয়ে মোড়ানো।
মামলা চলাকালে প্রধান আসামিকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনা, আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আসামিদের চোখ রাঙানি, নরঘাতকদের পক্ষে আদালতপাড়ায় শোডাউনসহ নানা ঘটনায় গেল পৌনে ৩ বছর ধরেই আলোচিত ছিল ৭ খুনের মামলাটি। তদন্ত শেষে প্রায় এক বছর পর ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল নূর হোসেন, র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় ডিবি পুলিশ। ওই বছরের ১৩ নভেম্বর নূর হোসেনকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনা হয়। দু’টি মামলায় নূর হোসেন ও র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ মোট ২৩ জন কারাগারে আটক রয়েছেন। আর চার্জশিটভুক্ত আসামিদের মধ্যে এখনো ১২ জন পলাতক রয়েছে।
২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দু’টি মামলায় নূর হোসেনসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। দু’টি মামলাতেই অভিন্ন সাক্ষী হলো ১২৭ জন করে। যার মধ্যে দু’টি মামলার বাদী, দু’জন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও প্রত্যক্ষদর্শীসহ ১০৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়। এরপর ২৪ অক্টোবর থেকে শুরু হয় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পড়ে শোনানো ও তাদের বক্তব্য গ্রহণের কার্যক্রম। ২১ নভেম্বর থেকে শুরু হয় যুক্তিতর্ক। গত ৩০ নভেম্বর শেষ হয় আলোচিত সাত খুন মামলার আইনি কার্যক্রম।
২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি সকাল ১০টা ৪ মিনিট থেকে ১০টা ৯ মিনিট পর্যন্ত তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন আলোচিত ৭ খুন মামলার রায় ঘোষণা করেন। নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নাসিকের বরখাস্তকৃত কাউন্সিলর নূর হোসেন, র্যাবের চাকরিচ্যুত অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব:) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, উপ অধিনায়ক মেজর (অব:) আরিফ হোসেন ও ক্যাম্প ইনচার্জ লে. কমান্ডার (অব:) এম এম রানাসহ ২৬ জনের ফাঁসির আদেশ দেন আদালত। বাকি ৯ জনের মধ্যে অপহরণ ও লাশ গুমের সঙ্গে জড়িত থাকায় এক আসামিকে ১৭ বছর, অপহরণের সঙ্গে জড়িত থাকায় ৬ জনকে ১০ বছর এবং লাশ গুমে জড়িত থাকায় ২ জনকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট সাত খুন মামলায় সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন, র্যাব-১১ এর সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অব.) আরিফ হোসেনসহ ১৫ জনের ফাঁসির রায় বহাল রাখে হাইকোর্ট। বাকি ১১ জনের ফাঁসির রায় পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
রায়ে যে ২৬ জনের ফাঁসির রায় দিয়েছিল নারায়ণগঞ্জের নিম্ন আদালত তাদের মধ্যে প্রধান চার আসামিসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড তথা ফাঁসির আদেশ বহাল রাখে হাইকোর্ট। ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত বাকি ১১ জনকে সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন দণ্ড দেওয়া হয়েছে।
এদিকে নিম্ন আদালত ও হাইকোর্টে মামলাটির কার্যক্রম দ্রুত চলমান থাকলেও আপিল বিভাগে এর কার্যক্রম অত্যন্ত ধীরগতিতে চলছে বলে অভিযোগ করেছেন নিহতের স্বজনরা। অপরদিকে মামলাটির রায় দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমে নরঘাতকদের ফাঁসি দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
৭ খুনে নিহত মনিরুজ্জামান স্বপনের ছোট ভাই মিজানুর রহমান রিপন বলেন, ‘আমরা বর্তমানে মামলাটির ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কায় আছি। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাদেরকে আশ্বস্ত করেছিলেন আলোচিত ৭ খুনের রায় যাতে দ্রুত কার্যকর হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন তিনি। আমরা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি কামনা করছি।’
আদমজী এলাকার বাসিন্দা হাবিবুর রহমান বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের ৭ খুন শুধু জাতীয় পর্যায়েই নয় আন্তর্জাতিকভাবেও আলোচিত হয়েছিল। এই ৭ খুনের ঘটনার নৃশংসতায় শিউরে উঠেছিল জাতি। আমরা দ্রুত এই ৭ খুন মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তদের রায় কার্যকর চাই। যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।’