চা শ্রমিকরা আজও অবহেলা, নিপীড়িত ও বঞ্চনার শিকার। দেড়শ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে তারা বাংলাদেশে বসবাস করে আসছেন। তবুও তাদের জীবন মানের কোনো উন্নতি হয়নি। চা গাছ ছেঁটে যেভাবে ২৬ ইঞ্চির বেশি বাড়তে দেওয়া হয় না, চা শ্রমিকের জীবনও যেন তেমনই।
শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান কোনোটাই যেন নেই চা শ্রমিকদের ভাগ্যে। তাদের শ্রমে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হলেও তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমশ নিম্ন থেকে নিম্নগামী হচ্ছে। সারাদিন হাড় ভাঙা পরিশ্রম করেও দিন শেষে জোটে মাত্র ১০২ টাকা মজুরি। নিজ দেশেই পরবাসী এসব চা শ্রমিকরা চান- ভূমি অধিকার, কুপির বদলে বিদ্যুৎ আর সন্তানদের শিক্ষার নিশ্চয়তা।
দেশের ১৬৪টি চা বাগানের মধ্যে হবিগঞ্জে রয়েছে ৪৫টি। যেখানে বসবাস করেন প্রায় সাড়ে তিন লাখ শ্রমিক। চা শিল্পে কর্মরত এসব শ্রমিকের সমস্যা পাহাড়সম। আধুনিক দাসত্বের শিকার চা শ্রমিকদের নেই নিজস্ব বাসস্থান।
দীর্ঘদিন আন্দোলনের পর ২০১৭ সালের ২০ আগস্ট ঢাকায় চা বাগান মালিকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ চা সংসদ’ -এর নেতাদের সঙ্গে ‘চা শ্রমিক ইউনিয়ন’ নেতাদের বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে চা শ্রমিকদের ১০২ টাকা হারে দৈনিক মজুরি নির্ধারণ করা হলেও চুক্তির মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার ২০ মাস পর ২০১৮ সালের ২৭ আগস্ট তা কার্যকর করা হয়। বর্তমানে হবিগঞ্জের চা বাগানগুলোতে নিয়মিত শ্রমিকরা দৈনিক ১০২ টাকা হারে মজুরি পাচ্ছেন। আর ১৫ টাকা দরে প্রতিদিন এক কেজি রেশনের আটা পান। সে অনুযায়ী নিয়মিত শ্রমিকরা দৈনিক মজুরি পাচ্ছেন মাত্র ১১৭ টাকা। আর অনিয়মিত শ্রমিকদের সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে ১০২ টাকাতেই। অথচ দেশের সরকারি-বেসরকারি যে কোনো প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা দৈনিক ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা হারে মজুরি পান।
চা শ্রমিকদের দাবি, ১০২ টাকা মজুরি দিয়ে বর্তমান বাজার দরের সাথে খাপ খাইয়ে চলা সম্ভব হচ্ছে না। বাজারে চালের কেজি যেখানে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা, সেখানে ১০২ টাকা দিয়ে কেবল ২ কেজি চালই কেনা সম্ভব। তেল-নুনসহ অন্যান্য খরচ করা সম্ভবই না। এ অবস্থায় দৈনিক মজুরি কমপক্ষে ২০০ টাকা করতে হবে।
চা শ্রমিকদের নেতারা জানান, দীর্ঘদিন দৈনিক ৬৯ টাকা মজুরিতে কাজ করেন চা শ্রমিকরা। ২০১৫ সালে দৈনিক ২৩০ টাকা মজুরি, লাভের ৫ শতাংশ, প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটি চালুসহ ২০ দফা দাবি আদায়ে আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনে দৈনিক মজুরি ১৬ টাকা বেড়ে ৮৫ টাকা হয়। পরে সেটি ১০২ টাকায় গেলেও তাদের ২০ দফার কোনো দাবিই পূরণ হয়নি। অবহেলিত এসব চা শ্রমিকদের ভাগ্য ফেরাতে নূন্যতম মজুরি ৪০০ টাকা করতে হবে।
মাধবপুর উপজেলার জগদীশপুর চা বাগানের শ্রমিক সাধন সাঁওতাল বলেন, ‘যুগ যুগ ধরে আমরা চা শ্রমিকরা নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দিন যাপন করছি। ১০২ টাকা মজুরি দিয়ে আমাদের চলে না। কোনো রকমে আমরা খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছি।’
আরতি কুমরী নামে এক নারী চা শ্রমিক বলেন, ‘বাবু গো, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হারাদিন কাম করে ১০২ টেকা পাই। আমাদের অনেক কষ্ট গো বাবু!’
প্রাথমিকেই সীমাবদ্ধ চা শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষা
সারাদেশে যখন শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রসার ঘটছে, তখনও শিক্ষা বঞ্চিত চা শ্রমিক সন্তানরা। বিশ্লেষকদের মতে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোনোর আগেই ঝড়ে পড়ে চা শ্রমিকদের ৯০ শতাংশ শিশু। আর বাঁকি ১০ শতাংশ ঝড়ে পড়ে সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণীতে। এর বড় কারণ হিসেবে তাঁরা দায়ী করেন, চা শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষায় অব্যবস্থাপনা ও সুযোগ-সুবিধার অভাবকে।
হবিগঞ্জ জেলার ৪৫টি চা বাগানের মধ্যে মাত্র ১৪টিতে রয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বাকিগুলোতে চুক্তি অনুযায়ী বাগান মালিকদের দেওয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়েই সীমাবদ্ধ চা শ্রমিক সন্তানদের শিক্ষা। আবার সেগুলোতেও নেই শিক্ষার নূন্যতম পরিবেশ। একজন শিক্ষক দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছে প্রতিটি স্কুল।
উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে লেখাপড়ার জন্য চা শ্রমিক সন্তানদের স্কুল যেতে হয় ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে। অথচ সরকার থেকে কোনো ধরনের শিক্ষা উপকরণ কিংবা শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে না শিক্ষার্থীদের।
স্থানীয় চা শ্রমিকরা জানান, স্কুলের ফি, বইপত্র, খাতা কিনতে অর্থের প্রয়োজন। আর সে অর্থ জোগাড় করতে না পেরে অনেকেই তাদের সন্তানদের ঋণ করে লেখাপড়া করাচ্ছেন।
সুদাংশু প্রধান নামের এক চা শ্রমিক জানান, অনেক কষ্টে ঋণ করে তিনি তার ছেলেকে এসএসসি পর্যন্ত পড়িয়েছেন। কিন্তু এখন আর সম্ভব হচ্ছে না।
অন্য এক চা শ্রমিক মনমোহন সাওতাল বলেন, ‘আমরা চা শ্রমিক হিসেবে যে জীবন কাটাচ্ছি তা অত্যন্ত অমানবিক। বাবা হিসেবে আমি চাই না আমার সন্তানও আমার মতো কষ্ট করে বেঁচে থাকুক। কিন্তু কী করব! আমাদের ভাগ্যই যেন খারাপ। পেটে খাবার পড়ে না, লেখাপড়া করাবো কী করে।’
চুনারুঘাট উপজেলার দেওয়ন্দি বাগানের ভাগিরতি কৈরী নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমার মা চা বাগানে কাজ করে। আর বাবা যখন যা পায় তাই করে। তিন কিলোমিটার দূরে পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতে হয়। যদি আমাদের বাগানে একটি স্কুল থাকতো তাহলে অনেক ভালো হতো।’
চিকিৎসা বঞ্চিত চা শ্রমিকরা
চা শ্রমিকের অর্ধেকের বেশি নারী শ্রমিক হলেও মাতৃত্ব কল্যাণ সুবিধা সংক্রান্ত বিষয়ে তাদের সুস্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। আবার সন্তান জন্মদানের পর শুরু হয় নারী শ্রমিকদের অন্য আরেক সংগ্রাম। কারণ তাদের নবজাত শিশুদের জন্য কোনো ডে কেয়ার সেন্টার নেই। ফলে সন্তান প্রতিপালন নিয়ে তাদের ব্যাপক ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়। সন্তান সম্ভবা হওয়ার পর থেকে সন্তান জন্মদানের পর তার যে বাড়তি পুষ্টির প্রয়োজন, তা বরাবরই অপূর্ণ রয়ে যায়।
হবিগঞ্জের অধিকাংশ বাগানেই নেই কোনো চিকিৎসা কেন্দ্র। আর যেগুলোতে আছে তাতেও শ্রমিকের জটিল কোনো রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয় না। পর্যাপ্ত ওষুধ ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি তেমন বলার মত কিছুই নেই। এমবিবিএস ডাক্তার নাই। সেখানে প্যারাসিটামল ছাড়া আর কোনো ওষুধ দেওয়া হয় না। বেশি সমস্যার কথা বললে সরকারি হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। অথচ সেখানে যাওয়ার মতো টাকা পয়সা তাদের হাতে থাকে না।
১৯৬২ সালের টিপ্ল্যান্টেশন লেবার অর্ডিন্যান্স এবং ১৯৭৭ সালের প্ল্যান্টেশন রুলসে চা শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার জন্য বাগান মালিকদের প্রতি সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও এর কোনো বাস্তব প্রতিফলন আজ অবধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
এ ব্যাপারে মাধবপুর উপজেলার সুমরা চা বাগানের নারী শ্রমিক সুবুদ্রা মুন্ডা বলেন, ‘সারাদিন রোদের মধ্যে কাজ করতে হয়। রাতে শরীতে ব্যথা করে, চুলকায়। জ্বর আসলেও ওষুধ পাওয়া যায় না।’
অন্য এক নারী শ্রমিক মনোহরা সাঁওতাল বলেন, ‘ছেলে মেয়ের চিকিৎসাই ঠিকমতো করাতে পারি না, আবার নিজের চিকিৎসা। আমাদের বাগানে কোনো হাসপাতাল নেই। কীভাবে চিকিৎসা করাব? আর সরকারি হাসপাতালে গেলে ১০০ টাকা লাগে, এত টাকা কই পামু।’
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন মাধবপুর ভ্যালি কার্যকরি পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক নৃপাল পাল বলেন, ‘যুগযুগ ধরে চা শ্রমিকরা বিভিন্নভাবে অবহেলিত একটি জনগোষ্ঠী। শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান কোনোটাই তারা ঠিকভাবে পাচ্ছ না। এছাড়া সারাদিন ক্রীতদাসের মতো খেটেও মজুরি পান মাত্র ১০২ টাকা। অথচ বর্তমানে বাংলাদেশের যে কোনো শ্রমিকরা ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা হারে দৈনিক মজুরি পাচ্ছে।’
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের উপাদেষ্টা হবিগঞ্জ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি ও চা শ্রমিকের ভূমি অধিকার কমিটির নেতা স্বপন সাঁওতাল বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধে ভূমি শত্রুমুক্ত করতে চা শ্রমিকরাও অংশগ্রহণ করেছেন। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সব মানুষ ভূমি অধিকার পেলেও চা শ্রমিকরা তা পাননি।’