এক সময় বাংলাদেশের সর্বত্র জালের ন্যায় ছড়িয়ে ছিলো বিভিন্ন নদ-নদী, খাল-বিল। আর এসব নদ-নদীর ওপর নির্ভর ছিলো বাংলাদেশের অর্থনীতি। বিশেষ করে বৈশাখ মাসে দূরের হাওর থেকে কাটা ধান বাড়িতে আনতে নদীপথ ছিলো সবচেয়ে সুবিধাজনক। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এখন আর আগের মতো নদ-নদী নেই। ফলে হাওর থেকে ধান আনতে কৃষকরা এখন আর নৌকা ব্যবহার করতে পারছেন না।
এদিকে, বিস্তীর্ণ হাওরজুড়ে এখনও তেমন স্থলপথ সৃষ্টি হয়নি। ফলে যাতায়াত দুরবস্থার কারণে বোরো ধান তুলতে ভোগান্তির পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন কৃষকরা। বছরের পর বছর ধরে এ অবস্থা চলে আসলেও সমস্যা সমাধানে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না সরকার। শুধুমাত্র নদী খনন করা হচ্ছে বলেই দায় সারছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, হবিগঞ্জে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় পাঁচশ’র অধিক হাওর রয়েছে। কোনো কোনো হাওরের দূরত্ব গ্রাম থেকে প্রায় ২০/২৫ কিলোমিটার। এসব হাওরে চাষাবাদ করতে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় কৃষকদের। হাওরে যাতায়াতের রাস্তা না থাকায় জমির আল দিয়ে ২০/২৫ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে চাষাবাদ করতে যেতে হয়। সেই সঙ্গে কৃষি সামগ্রীও নিতে হয় মাথায় অথবা কাঁধে করে। এতে সময় নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি অতিরিক্ত শ্রমিক খাটাতে হচ্ছে।
বিশেষ করে বৈশাখ মাসে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়তে হয় কৃষকদের। এ সময় বোরো ধান ঘরে তুলেন হাওরের কৃষকরা। যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো না থাকার কারণে দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে হাওর পাড়ের কৃষকদের। সেই সাথে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন কৃষকরা, বাড়ছে শ্রমিক সংকট।
কৃষকদের দাবি, এক সময় হাওরের বিভিন্ন দিকে নদ-নদী ছিলো। ফলে তারা (কৃষকরা) দূর-দূরান্তের ধান নৌকা দিয়ে নদী পথে নিয়ে আসতেন। কিন্তু এখন হাওরের সব কয়টি নদী বৈশাখের আগেই শুকিয়ে যায়। কোনো কোনো নদীতে হচ্ছে চাষাবাদও। আবার হাওরের বুকে বিভিন্ন ধরণের মালবাহি গাড়ি যাওয়ার রাস্তা নেই। ফলে দূরের ধান আনতে হচ্ছে মাথায় অথবা কাঁধে করে। যে জমিতে আগে ৫ জন শ্রমিক লাগতো সেখানে বর্তমানে শ্রমিক লাগছে ১০ জনের অধিক। কারণ ধান মাঠে আনতেই শ্রমিকের ব্যয় হচ্ছে কাটার চেয়ে অধিক সময়। সেই সাথে দূর থেকে ধান বয়ে আনার ভয়ে মিলছে না শ্রমিকও।
এদিকে, মাঠে নিয়ে আসার দূর্ভোগের কারণে কেউ কেউ জমির পাশেই মাড়াই করে কম দামে বিক্রি করে দিচ্ছেন ধান। আবার হাওরের বুকে মাড়াই করা ধান পাহারা দিতে গিয়ে বাড়ছে বজ্রপাতে মৃত্যুর শঙ্কাও।
এ ব্যাপারে আমজিরীগঞ্জ সদরের কৃষক মো. কদম আলী বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘এক সময় আমাদের বাপ-দাদারা নৌকা দিয়ে ধান নিয়ে আসতেন। কিন্তু আমরা তা পারছি না। কারণ নদীগুলো এখন শুকিয়ে গেছে। সেই সাথে ট্রাক্টর দিয়ে যে দূর থেকে ধান আনব সেই সুযোগও নেই। কারণ হাওরে ট্রাক্টর যাওয়ার রাস্তা নেই।’
একই উপজেলার কৃষক মো. শহীদ মিয়া বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘নদীগুলো খনন করলে আমরা কৃষকদের অনেক ভালো হতো। ১৫/২০ কিলোমিটার জায়গা মাথায় করে ধান আনতে গিয়ে ১০ জনের জায়গায় ২০ জন কামলা (শ্রমিক) লাগছে। আবার দূর থেকে ধান আনার ভয়ে কামলাও পাওয়া যাচ্ছে না।’
বানিয়াচং উপজেলার সাংঙ্গর গ্রামের কৃষক আনোয়ার হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘আমরা কতটা সমস্যায় আছি তা দেখার কে আছে? ধান ফলানো কত কষ্ট, অথচ দামের বেলায় চারশ’ থেকে সাড়ে চারশ’ টাকা মণ। এক কের ধান কাটতে যে খরচ হয় তাও পাওয়া যায় না। যদি সরকার হাওর দিয়ে একটি রাস্তা করে দিত তাহলে আমাদের কিছুটা খরচ বাঁচত।’
এ ব্যাপারে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ আলী বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘কৃষকদের হাওরের ধান আনার সুবিধার্থে নদীগুলো খনন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে নদী খননের একটি প্রজেক্ট শুরু হয়েছে। যা পানি উন্নয়ন বোর্ড বাস্তবায়ন করছে।’