হবিগঞ্জে হঠাৎ করেই বেড়েছে অপরাধ প্রবণতা। গত এক সপ্তাহে হবিগঞ্জে স্বামীর হাতে স্ত্রী খুনসহ মোট ৫টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। একই সাথে বেড়েছে সংঘর্ষ, চুরি-ছিনতাই ও রাহাজানির ঘটনা। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবণতির কারণেই অপরাধ বাড়ছে। আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, অলস সময়ের কারণেই তুচ্ছ ঘটনায় অপরাধে জড়াচ্ছে সাধারণ মানুষ।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জমি নিয়ে বিরোধের জেরে গত ৮ জুন মাধবপুরে শাহজাহান মিয়া (৩৫) নামে এক চা দোকানিকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ৭ জুন লাখাইয়ে সমিতির টাকা ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে দু’পক্ষের সংঘর্ষে নিহত হন জহিরুল ইসলাম (৩৫) নামে এক ব্যক্তি এবং আহত হন পুলিশসহ ৩৫ জন। ঘটনায় পরদিন পুলিশ গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে মামলা করে।
গত ১৩ জুন বাহুবলে কাওছার মিয়া তার স্ত্রী রুমা বেগমকে (৩৫), ১২ জুন চুনারুঘাটে উপজেলার মিরাশী ইউনিয়নের আদমপুর গ্রামের মো. ফরিদ মিয়া তার স্ত্রী রীনা আক্তারকে (৩৫) শ্বাসরোধ করে। গত ১১ জুন জেলার শায়েস্তাগঞ্জে পারিবারিক কলহের জেরে কিশোর দাস তার স্ত্রী মুক্তা রাণী দাসকে কুপিয়ে হত্যা করে।
এদিকে, জেলায় শুধু খুনই নয়, সমান তালে বেড়েছে চুরি ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা। এমনকি ছিনতাইকারীর হাতে খুন হচ্ছেন অনেকে। গত ২৭ মে টমটম অটোরিকশা চালক সাবাজ মিয়াকে (২৫) শহরের আনোয়ারপুর এলাকা থেকে শায়েস্তাগঞ্জ যাওয়ার জন্য ভাড়া করেন একদল ছিনতাইকারী। ধুলিয়াখাল বাইপাস এলাকায় পৌঁছালে ছিনতাইকারীরা চালক সাবাজ মিয়াকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে রাস্তার পাশে ফেলে দেয়। পরে ছিনতাইকারীরা টমটম নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। যদিও এ সময় পুলিশ তিন ছিনতাইকারীকে আটক করে।
গত ১০ জুন চুনারুঘাট উপজেলার রানীগাঁও ইউনিয়নের চাটপাড়া গ্রামে ও ১১ জুন ভোররাতে বাহুবল উপজেলার হরিপাশা গ্রামের ব্যবসায়ী মো. মকসুদ মিয়ার বাড়িতে দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ডাকাতরা পরিবারের সদস্যদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ঘরে থাকা নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার ও মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে। অপরদিকে, হবিগঞ্জ শহরে মোটরসাইকেল চুরির হিড়িক পড়েছে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সাংবাদিক এবং পুলিশও রেহাই পাচ্ছেন না চোরদের কাছ থেকে।
গত ১১ জুন সদর হাসপাতালের সামন থেকে সাংবাদিক ফরহাদ হোসেনের মোটরসাইকেল, ১০ জুন জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে থেকে তরফ বার্তার সম্পাদক এবং উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান আউয়ালের মোটরসাইকেল চুরি হয়।
হঠাৎ জেলায় অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন সংশ্লিষ্ট সচেতন মহল। তাদের দাবি, আইন-শৃঙ্খলার অবণতির কারণেই এসব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহীনিকে আরও সতর্ক হতে হবে।
এ ব্যাপারে সাংবাদিক ও আইনজীবী এমএ মজিদ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘আইনের ফাঁক দিয়ে অপরাধীরা সহজেই জামিন পেয়ে যায়। এছাড়া মামলার দীর্ঘসূত্রীতার কারণে অপরাধীরা বারবার অপরাধ করতে দ্বিধা করে না। আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা প্রশাসনিক কাজে বেশি ব্যস্ত থাকায় জেলার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থির প্রতি তাদের তেমন নজর নেই। ফলে জেলায় অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে।’
মানবাধিকার সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর ল রিসার্চ অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ (এলার্ট)-এর হবিগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবী মনসুর উদ্দিন আহমেদ ইকবাল বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘ইদানিং হবিগঞ্জে সংঘর্ষ, খুন, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই-রাহাজানি উদ্বেগজনকহারে বেড়েছে। মূলত জনসচেতনতার অভাবের কারণে এসব হচ্ছে। তাই এসব বন্ধে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও পুলিশসহ সবাইকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় ও অপরাধীদের সাজা না হওয়ায় অপরাধ প্রবনতা বাড়ছে। এর জন্য আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।’
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘বর্ষার মৌসুম হওয়ায় সাধারণ মানুষ অনেকটা অলস সময় কাটচ্ছে। এ সময় তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তারা আপন ভাই, আত্মীয়-স্বজন, এমনকি স্ত্রীর সঙ্গে কাটাকাটিতে জড়াচ্ছে। এক পর্যায়ে খুন করতে দ্বিধা করছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘হবিগঞ্জ অত্যন্ত সংঘর্ষপ্রবণ এলাকা। ফলে সংঘর্ষ প্রতিরোধে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ইউনিয়নে প্রতিনিধি পাঠিয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। এছাড়া কুইজ ও বিতর্ক প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হচ্ছে।’