শত বছরের পুরনো রেলব্রিজ ও ত্রুটিপূর্ণ লাইন দিয়েই বছরের পর বছর ধরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করছেন সিলেট বিভাগের চার জেলার কয়েক লাখ মানুষ। সামান্য ঝড় বৃষ্টি হলেই রেল লাইন থেকে মাটি সরে মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয় দেশের সবচেয়ে বড় এ যোগাযোগ মাধ্যমটি। বিভিন্ন সময় ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটলেও বিষয়টি নিয়ে কোনো মাথাব্যাথা নেই রেল কর্তৃপক্ষের। দেশের নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থার শীর্ষস্থানে রেলপথ থাকলেও ঢাকা-সিলেট রেলপথের প্রতিটি স্লিপার যেন একেকটা মৃত্যুফাঁদ।
১৭৬ কিলোমিটারের ঢাকা-সিলেট রেলপথটি ব্রিটিশ আমলের তৈরি। ঢাকা থেকে ভৈরব পর্যন্ত ডাবল লাইন স্থাপন করা হলেও ভৈরব থেকে সিলেট পর্যন্ত লাইন ঝুঁকিপূর্ণ। শতবছরের পুরোনো এই পথটিতে মাঝে-মধ্যে সংস্কার করা হলেও অধিকাংশ স্থানের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। আর সেতুগুলোর কথা বর্ণানা করার মতো নয়। নড়বড়ে এই রুটের প্রতিটি সেতুতে ট্রেন উঠলে কাঁপতে শুরু করে।
সচেতন মহলের দাবি, শুধুমাত্র ঢাকা-সিলেট রেলপথে যে পরিমাণ দুর্ঘটনা ঘটে তা সম্পূর্ণ দেশের রেলপথে ঘটে না। কখনও পাহাড়ি ঢলে রেললাইনের নিচ থেকে মাটি সরে যায়। আবার কখনও ব্রীজ ভেঙে যায়। তবে সবচেয়ে বেশি ঘটে লাইনচ্যুতের ঘটনা। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে, এই রুটের অধিকাংশ স্লিপারে নেই নাট-বলটু। ঘূণ-পোকায় খাওয়া কাঠের ওপর ভর করে হাজারও জীবন নিয়ে প্রতিদিন ছুটে চলে ৬টি আন্তঃনগরসহ বেশ কয়েকটি লোকাল ট্রেন।
রেল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, ঢাকা-সিলেট-চট্টগ্রাম রেলপথে পারাবত, জয়ন্তীকা, পাহাড়িকা, উদয়ন, উপবন ও কালনী এক্সপ্রেস নামের ৬টি আন্তঃনগর ট্রেন প্রতিদিন দুইবার করে ১২ বার আসা-যাওয়া করে। আর এই পথে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করেন অন্তত ২৫/৩০ হাজার যাত্রী।
এদিকে, ছয়টি রেল সেতুকে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় রেখেছে রেল কর্তৃপক্ষ। তবে তারা এটিকে ঝুঁকিপূর্ণ বলতে রাজি নন। তাদের দাবি এগুলো মেরামতযোগ্য। তাদের তালিকায় থাকা ছয়টি রেলব্রীজ হলো- হবিগঞ্জের শাহজিবাজারে ৭৩ নম্বর সেতু, লস্করপুরে ১০২ নম্বর সেতু, শায়েস্তাগঞ্জে ১০৫ নম্বর সেতু, বাহুবলের রশিদপুরে ১১৪ নম্বর সেতু, কমলগঞ্জের ভানুগাছে ১৮৩ নম্বর সেতু এবং ছাতকে ৩২ নম্বর সেতু। আর রেললাইনের ত্রুটি নিয়ে কথা বলতে গেলে তাদের দাবি, কিছু কিছু অংশে সমস্যা আছে। কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা নেই।
সরেজমিনে দেখা যায়- ঢাকা-সিলেট রেলপথ এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ যে যাত্রীরা দেখলে হয়তো এই পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতেন না। হবিগঞ্জের মাধবপুর থেকে মৌলভীবাজার পর্যন্ত প্রতিটি স্থান মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। রেললাইনের কোনো স্লিপারেই নাট-বল্টু নেই। কোনোটাতে একটি, আবার কোনোটাতে একটিও নেই। অনেক স্থানে কাঠের ওপর থেকে লাইনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আবার কোথাও কোথাও ঘুণ-পোকায় খেয়ে ফেলেছে কাঠের স্লিপার। দেখলে মনে হবে এই লাইন দিয়ে হয়তো বেশ কয়েক বছর ধরে রেল চলে না।
অভিযোগ রয়েছে- ঢাকা-সিলেট রেলপথের হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার অংশে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। এর একমাত্র কারণ ত্রুটিপূর্ণ রেলপথ। ত্রুটির কারণে বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনা ঘটলে দিনব্যাপী সারাদেশের সাথে বন্ধ হয়ে পড়ে সিলেটের রেল যোগাযোগ। দূর্ভোগ পোহাতে হয় হাজার হাজার যাত্রীকে। আবার দুর্ঘটনা কবলিত স্থানটিতে জোড়াতালি সংস্কার করে পুনরায় চালু করে দেওয়া হয় যোগাযোগ। স্থায়ী সমাধানের চিন্তাই যেন কর্তৃপক্ষের মাথায় আসে না।
অন্যদিকে দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত তিন বছরে অন্তত ২০/২৫টি দুর্ঘটনা ঘটেছে ঢাকা-সিলেট রেলপথে।
সব চেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটেছে রোববার (২৩ জুন) রাতে। সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা ‘উপবন এক্সপ্রেস’র কয়েকটি বগি সেতু ভেঙে খালে পড়ে ও লাইনচ্যুত হয়ে অন্তত ৮ জন নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত কয়েক শতাধিক যাত্রী। মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল স্টেশন থেকে ২০০ মিটার দূরে কালা মিয়া বাজার সংলগ্ন সেতু ভেঙে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
এই স্থানটিতে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে লুৎফুর রহমান রাজু নামে এক ব্যক্তি গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। অবশেষে তার আশংঙ্কাই বাস্তবায়িত হলো।
চলতি বছরের ২ জুন সকালে হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার রশিদপুরে ‘কুশিয়ারা’ ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। এতে সিলেটের সাথে সারাদেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। পরে ১৬ ঘন্টার দূর্ভোগ দিয়ে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
এর আগে ৬ এপ্রিল সিলেটের মাইজগাঁওয়ে মালবাহী একটি ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয়ে সিলেটের সাথে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ওইদিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে দুর্ঘটনাটি ঘটে। এ সময় সিলেট থেকে ছেড়ে যায় যাত্রীবাহী ‘উপবন এক্সপ্রেস’ মোগলাবাজার স্টেশনে আটকা পড়ে। দূর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা।
২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের রেলওয়ের ১৪১ নম্বর সেতুর মাটি সরে রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
একই বছরের ২৯ মার্চ হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার ইটাখোলা এলাকার ৫৬ নম্বর ব্রিজে বৃষ্টির পর মাটি সরে যায়। পরদিন মেরামতের সময় একটি পিলার ধসে গেলে সারাদেশে সঙ্গে সিলেটের ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। চারদিন সারাদেশের সাথে সিলেটের রেল যোগাযোগ বন্ধ থাকার পর স্বাভাবিক হয়। কিন্তু একদিন পর আবারও ফের বন্ধ হয়ে পড়েছে যোগাযোগ।
এর আগে একই বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের ভাড়াউড়া এলাকায় ১৫৭ নম্বর সেতুর পিলারের নিচ থেকে মাটি সরে সেতুটি দেবে যায়। এতে রেল যোগাযোগ ১৪ ঘণ্টা বন্ধ থাকে।
২০১৬ সালের ৭ অক্টোবর হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার নোয়াপাড়ায় ‘পারাবত এক্সপ্রেস’ ট্রেনের তিনটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে ইঞ্জিনে আগুন লেগে যায়। এতে বেশ কয়েকজন আহত হন।
এ সব বড় বড় দুর্ঘটনা ছাড়াও ঢাকা-সিলেট রেলপথে প্রতিনিয়তই ঘটছে দুর্ঘটনা। বিষয়টি নিয়ে যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করলেও নাকে তেল দিয়েই ঘুমাচ্ছেন কর্তৃপক্ষ। বৃহত্তম এই যোগাযোগ ব্যবস্থায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাত্রীরা চলাচল করলেও রেল কর্তৃপক্ষ লাইন সংস্কারের কোনো উদ্যোগই নিচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক যাত্রী।
সম্প্রতি ঢাকা-সিলেট রেলপথ নিয়ে মনোয়ার হোসেন খান রুবেল নামে এক যাত্রী বলেন- ‘আমরা রেলপথকে সব চেয়ে নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা মনে করি। কিন্তু ঢাকা-সিলেট রেলপথে যে পরিমাণ দুর্ঘটনা ঘটে এর পর রেলে যেতেই ভয় করবে।’
তিনি বলেন, ‘এই রেলপথটি এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ যে কি বলব! দ্রুত এটি সংস্কার করা প্রয়োজন। না হলে কখন কি হয় বলা যায় না।’
এ ব্যাপারে সিনিয়র সাংবাদিক ও আইনজীবী মনসুর উদ্দিন আহমেদ ইকবাল বলেন, ‘আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন যে রেলপথ ছিলো এখনও সেটিই আছে। অনেকগুলো ব্রীজ রয়েছে যেগুলোতে ট্রেন উঠলে ভয় করে। অথচ অতি ঝুঁকিপূর্ণ হলেও এই পথটি সংস্কারের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘বড় কোনো দুর্ঘটনার শঙ্কা আমরা করেছিলাম। এখন আমাদের শঙ্কাই ঠিক হলো। এতগুলো মানুষ হতাহতের দায় রেল কর্তৃপক্ষের।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কথা বলতে রাজি হননি শায়েস্তাগঞ্জ রেল স্টেশনের সহকারী মাস্টার গৌর প্রসাদ দাশ। তিনি বলেন, ‘এখন রেলপথ নিয়ে কথা বলার সময় না। দুর্ঘটনা কবলিতদের উদ্ধার করা প্রয়োজন বেশি।’
এর আগে ২০১৭ সালের ১ এপ্রিল মাধবপুরের ইটাখোলায় সেতু দেবে যাওয়ার পর রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী শহীদুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে বলেছিলেন, ‘ঢাকা-সিলেট রেলপথে যেসব সেতু দুর্বল, সেগুলোর স্থানে নতুন সেতু নির্মাণ করা হবে। এর জন্য দরপত্র গ্রহণ করেছেন।’
কিন্তু দুই বছর অতিক্রম হলেও এ নির্মাণকাজ শুরু হয়নি। এ বিষয়টি নিয়েও যাত্রীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে।