অবিরাম বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট ভয়াবহ বন্যায় ছয় দিন ধরে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে বান্দরবান। লামা উপজেলার মধুঝিড়ি এলাকায় পাহাড় ধসে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে।
বন্যায় বান্দরবান-কেরানীহাট প্রধান সড়ক প্লাবিত হওয়ায় রোববার (১৪ জুলাই) ষষ্ঠদিনের মত সারাদেশের সঙ্গে বান্দরবানের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়ে যায়। তবে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় রোববার দুপুরের পর বন্যায় প্লাবিত অভ্যন্তরীণ সড়কগুলো থেকে পানি নেমে যায়।
কিন্তু প্লাবিত এলাকাগুলোর অধিকাংশ বসতবাড়ি এখনো বন্যার পানিতে তলিয়ে আছে। বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে সাঙ্গু নদীর পানি। যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সংকট দেখা দিয়েছে স্থানীয় হাট-বাজারে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফায়দা নিয়ে ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ, রসুন, মোমবাতি, ভোজ্য তেল, ডিম, শাক-সবজি এবং মাছ-মাংস-মুরগির দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, অবিরাম ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে পার্বত্য জেলা বান্দরবানের সাতটি উপজেলায় অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোতে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। পাহাড় ধসে সদরের কালাঘাটা, হাফেজঘোনা, ইসলামপুর, বনরুপা পাড়াসহ আশপাশের এলাকাগুলোর বেশকিছু ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এছাড়ও লামা উপজেলার মধুঝিড়ি এলাকায় বসতবাড়িতে পাহাড় ধসে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। নিহত নারীর নাম নূর জাহান (৬৫)। তিনি স্থানীয় বাসিন্দা নূর হোসেনের স্ত্রী। পাহাড় ধসে নিহত নূর জাহানের পুত্র মোহাম্মদ ইরান এবং পুত্রবধূ ফাতেমা বেগম আহত হয়েন।
খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে হতাহতদের উদ্ধার করে। আহতদের লামা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
লামার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আপেলা রাজু নাহা জানান, ঝুঁকিপূর্ণ বসতি থেকে পাহাড় ধসে হতাহতদের আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু রোববার সকালে তারা আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়ে পালিয়ে বসতবাড়িতে ফিরে গেলে পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনাটি ঘটে।
গত ৬ জুলাই থেকে অব্যাহত ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে জেলার রুমা, থানচি, রোয়াংছড়ি, লামা, আলীকদম এবং সদর উপজেলায় ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ছয়টি উপজেলা এবং দুটি পৌরসভায় কমপক্ষে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ বন্যায় ক্ষতির শিকার হয়েছেন।
বন্যায় পুলিশ সুপারের বাংলো, ডিসিবাংলো, জজকোর্ট, নির্বাচন অফিস, ইউএনও অফিস, রোয়াংছড়ি-লামা থানা, পুলিশ লাইন্স, বনবিভাগ, পার্বত্য জেলা পরিষদের রেস্টহাউজ, ক্যান্ট: পাবলিক স্কুল ও কলেজ, অরুণসার্কি টাউনহল, ফায়ারসার্ভিস অফিস, ক্রীড়া অফিস, সেনাবাহিনীর এমডিএস এলাকা, অফিসার্স ক্লাব, মহিলা ক্লাব সবগুলো প্লাবিত হয়েছে।
এছাড়াও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আবাসিক হোটেল হিলভিউ, হিলটন, রিভারভিউ, পূরবী এবং বাজারের বেশকিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
রুমা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শৈমং মারমা বলেন, ১৯৯৭ সালের পর বিগত বাইশটি বছরে এত বড় বন্যা আর হয়নি। রুমা বাজারসহ আশপাশের এলাকাগুলো বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। সড়ক-ব্রিজ ডুবে যাওয়ায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাও। বন্যা ও পাহাড় ধসে রাস্তাঘাট-ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
থানচি সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাংসার ম্রো বলেন, সাঙ্গু নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় থানচি বাজারসহ আশপাশের এলাকাগুলো বন্যায় প্লাবিত হয়। নদী তীরবর্তী অসংখ্য ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অভ্যন্তরীণ সড়কের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
রোয়াংছড়ি সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান চহ্লামং মারমা বলেন, রোয়াংছড়ি স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা হয়েছে এবার। রোয়াংছড়ি ইউএনও অফিস, থানা, এলজিইডি অফিস এবং বাজার এলাকার সবগুলো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান-ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে বন্যার পানিতে। রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখনো বিচ্ছিন্ন রয়েছে সড়ক যোগাযোগ।
বান্দরবান পৌরসভার মেয়র মো. ইসলাম বেবী এবং লামা পৌরসভার মেয়র জহিরুল ইসলাম বলেন, বন্যা-পাহাড় ধসে পৌরসভার রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অনেক স্থানে ধসে গেছে সড়ক। বন্যা-পাহাড় ধসে পৌরসভার নয়টি ওয়ার্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে লোকজনের ঘরবাড়ি। প্লাবিত অঞ্চলের মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। খাদ্য-বাসস্থান সবকিছুর সংকট তৈরি হয়েছে এবারের বন্যায়। তবে প্লাবিত এলাকাগুলো থেকে বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে।