গত এক সপ্তাহ ধরে কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমর, ফুলকুমরসহ ১৬ টি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। সরকারি হিসাব মতে, প্লাবিত হয়ে পড়েছে জেলার ৯ উপজেলার ৫৫ ইউনিয়নের ৩৯০টি গ্রাম। বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে প্রায় ৩ লাখ মানুষ। বন্যা দুর্গত এলাকাগুলোতে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। এসব এলাকার মানুষজন ঘর-বাড়ি ছেড়ে পার্শ্ববর্তী উঁচু বাঁধ ও পাকা সড়কসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিচ্ছে।
অন্যদিকে কুড়িগ্রাম-ভুরুঙ্গামারী মহাসড়কের বিভিন্ন স্থান তলিয়ে যাওয়ায় বন্ধ রয়েছে নাগেশ্বরী, ভুরুঙ্গামারী ও ফুলবাড়ী উপজেলাসহ সোনাহাট স্থল বন্দরের যোগাযোগ ব্যবস্থা। সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় গত দুইদিন ধরে বন্ধ রয়েছে উত্তরবঙ্গের সর্ববৃহৎ যাত্রাপুর হাটের সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা। বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে রাস্তা-ঘাট তলিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে যাওয়ায় এসব এলাকায় যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম এখন নৌকা ও কলাগাছের ভেলা। কিন্তু পর্যাপ্ত নৌকা না থাকায় অনেক পানি বন্দি মানুষ বাড়ি থেকে বের হতেও পারছেন না।
সদর উপজেলার কাঠালবাড়ী ইউনিয়নের বাংটুর ঘাট এলাকার শহর রক্ষা বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে। উলিপুর উপজেলার গুনাইগাছ ইউনিয়নের নাগড়াকুড়া এলাকায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাঁধের ১৫০ মিটার তিস্তার পানির প্রবল স্রোতে ধসে গেছে। জেলার ক্ষতিগ্রস্থ ও হুমকির মুখে পড়া তীররক্ষা বাঁধে জরুরি ভিত্তিতে জিও ট্রেক্সটাইল ব্যাগে বালুর বস্তা ফেলে রক্ষার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
এদিকে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার কুড়িগ্রামের ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ পরিদর্শন করে বাঁধগুলো দ্রুত মেরামত করার নির্দেশ দিয়েছেন।
স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানায়, সেতু পয়েন্টে ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ১১০ সেন্টিমিটার, চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপদসীমার ১০৫ সেন্টিমিটার, নুনখাওয়া পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৭৫ সেন্টিমিটার এবং কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তার নদীর পানি বিপদসীমার ১১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বন্যা কবলিত মানুষজন জানান, গত ৪ দিন ধরে নদ-নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন তারা। এ অবস্থায় কেউ কেউ ঘর-বাড়ি ছেড়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিলেও অনেক পরিবার এখনও পানির মধ্যে অবস্থান করছেন। ঘর-বাড়িতে অবস্থান করা পরিবারগুলোর রান্নার চুলা ও খড়ি পানির নীচে থাকায় রান্নার কাজ বন্ধ রয়েছে। ঘরের সঞ্চিত শুকনো খাবার শেষ হয়ে যাওয়ায় খাবারের সংকটে পড়েছেন তারা। অনেক পরিবারের নলকুপ তলিয়ে যাওয়ায় পান করছেন বন্যার পানি। চরাঞ্চলগুলোতে শুকনো জায়গা না থাকায় গবাদি পশু ও তাদের খাদ্য নিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন বন্যা দুর্গতরা।
সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের বড়ুয়ারচর গ্রামের শামসুল হক জানান, গত ৬ দিন ধরে পরিবার পরিজন নিয়ে বাঁশের উঁচু করা মাচানে বন্যার পানির মধ্যেই কোন রকমে বসবাস করছি। রান্না করতে পারছি না। ঘরের শুকনো খাবার শেষ হয়ে যাওয়ায় পরিবার পরিজন নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছি। এখন পর্যন্ত কোন সাহায্য সহযোগিতা পাইনি।
একই ইউনিয়নের রলাকাটার চরের ইদ্রিস আলী জানান, ঘরের ভিতর কোমর পানি। তবুও কষ্ট করে আছি। নৌকা খুঁজছি। নৌকা পেলেই ছেলে-মেয়েদের নিয়ে উঁচু জায়গায় চলে যাবো।
উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন জানান, আমার ইউনিয়নের ২২ হাজার পরিবার পানিবন্দি। এদের বেশির ভাগই ব্রহ্মপুত্রের তীরবর্তী দরিদ্র শ্রেণির মানুষ। গত ৫ দিন ধরে বেশির ভাগ মানুষ পানি বন্দি জীবন-যাপন করছে। এখন পর্যন্ত সরকারি কোনো ত্রাণ সামগ্রী বন্যা দুর্গতদের মাঝে বিতরণ করা হয়নি। তবে আজ সোমবার বরাদ্দকৃত ২ মেট্রিক টন চাল পাওয়ার কথা। চাল পেলে তালিকা অনুযায়ী বিতরণ করা হবে।
উলিপুর উপজেলার বজরা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রফিকুল আমিন জানান, আমার ইউনিয়নের ৯টি মৌজার মধ্যে ৯টি মৌজার মানুষই পানিবন্দি। এসব পানি বন্দি বেশিরভাগ মানুষ উঁচু বাঁধ ও পাকা সড়কে আশ্রয় নিলে ত্রিপাল বা ঢেউটিনের অভাবে সাময়িক মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি করতে পারছেন না। ফলে খোলা আকাশের নীচে অনেক পরিবার বসবাস করছে। তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ খাবার পানি। কেন না বন্যা কবলিত মানুষজনের ঘর-বাড়ি তলিয়ে থাকায় তারা রান্না-বাড়ার কাজ করতে পারছেন না।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান জানান, আমার ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের সাড়ে ১০ হাজার পরিবার পানি বন্দি। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে চর বড়াইবাড়ী, মাধবরাম, কাচিচর, মধ্যকুমরপুর ও উত্তর কুমরপুর। আমি রোববার আড়াই মেট্রিকটন চাল বরাদ্দ পেয়ে বিতরণ করেছি। তবে সব পরিবারকে দেয়া সম্ভব হয়নি।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিলুফা ইয়াছমিন জানান, সদর উপজেলায় বন্যা কবলিত মানুষজনের ৭০ মেট্রিক টন চাল, ১ লাখ টাকা ও ৩০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
কুড়িগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো: হাফিজুর রহমান জানান, বন্যা কবলিত মানুষের জন্য জেলার ৯ উপজেলায় ২৮০ মেট্রিক টন জিআর চাল, ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার এবং ৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যা বিতরণ করা হচ্ছে। নতুন করে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ে ২০ লাখ টাকা, ১০ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার ও ১ হাজার মেট্রিক টন জিআর চালের বরাদ্দ পত্র পাঠানো হয়েছে। সব উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।