বঙ্গবন্ধুপ্রেমী কাঠমিস্ত্রি আব্দুর রশিদ

ময়মনসিংহ, দেশের খবর

রকিবুল ইসলাম রাকিব, উপজেলা করেসপেন্ডেন্ট, বার্তাটোয়ান্টিফোর.কম, গৌরিপুর (ময়মনসিংহ) | 2023-08-29 07:52:03

বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন আব্দুর রশিদ (৬৮)। শরীরের চামড়ায় পড়েছে ভাঁজ। চলাফেরা তার সীমিত। চোখেও কম দেখেন। কিন্তু প্রতিবছর ১৫ আগস্ট আসলেই একা ছুটে যান সুদূর টুঙ্গিপাড়ায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাজার জিয়ারত করতে।

এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বুধবার (১৪ আগস্ট) দুপুরে ময়মনসিংহ থেকে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার পথে একা রওনা হয়েছেন এই বঙ্গবন্ধুপ্রেমী। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মাজার জিয়ারত করে বাড়ি ফিরবেন।

আব্দুর রশিদের বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুরের বোকাইনগর ইউনিয়নের বাঘবেড় গ্রামে। পেশায় তিনি একজন কাঠমিস্ত্রি। বয়স হওয়ায় বাড়িতে বসে টুকটাক কাজ করে টাকা জমিয়ে রাখেন আগস্ট মাসে টুঙ্গিপাড়া যাওয়ার জন্য।

বুধবার দুপুরে আব্দুর রশিদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, টুঙ্গিপাড়া যাওয়ার আগে বাবার ব্যাগ গোছাচ্ছেন রশিদের মেয়ে জুলেখা বেগম। আর বারান্দায় বসে রশিদ পরম মমতায় বঙ্গবন্ধুর ছবি হাতে নিয়ে চোখ বুলাচ্ছেন।

কিছুক্ষণের আলপচারিতায় আব্দুর রশিদ বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে জানান, তরুণ বয়সেই নেতৃত্বের গুণাবলির জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা জন্মে উঠে তার। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের ডাক দিতে পারেন, এই ধারণা থেকেই ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ময়মনসিংহে আনসার বাহিনীর সশস্ত্র ট্রেনিং নেন। ২৬ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ডাকে নেত্রকোনায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি।

যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় নেত্রকোনার নাজিরপুর, বড়াইল, বাইশদার ও নেত্রকোনা শত্রুমুক্ত করার যুদ্ধ এখনো শিহরণ জাগায়। নেত্রকোনা শত্রুমুক্ত করার আগে ইন্ডিয়ান আর্মি ক্যাপ্টেন চৌহানের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পনা হয়। ৯ ডিসেম্বর ভোররাতে পাকবাহিনীর ওপর আমরা আক্রমণ করি। আমি ময়মনসিংহ সড়কে থেকে যুদ্ধ করেছিলাম। ঐ যুদ্ধে আমার পাশে থাকা সহযোদ্ধা আব্দুর রশিদ, আবু খা ও আব্দুস ছাত্তার শহীদ হন।’

জানা যায়, দেশ স্বাধীনের পরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন রশিদ। ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট গ্রামে ধানের চারা রোপণ করছিলেন রশিদ। এমন সময় ইউনুস কমিশনার রেডিওতে খবর শোনে সংবাদ দিলেন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। এরপর ঐ ধান ক্ষেতের পাশেই বঙ্গবন্ধুর স্মরণে একটি মেহগনি গাছ রোপন করেন। নাম দিলেন বঙ্গবন্ধু স্মৃতি।

আব্দুর রশিদ বলেন, ‘সন্তানের মতোই যত্ন করে গাছটি বড় করেছিলাম। কিন্তু অন্যের জমিতে পড়ে যাওয়ায় ২৫ বছর পর ঐ গাছটি কেটে ফেলতে হয়। অনেক অনুনয় করেও গাছটি রক্ষা করতে পারিনি।’

আব্দুর রশিদের সাথে কথা বলতে বলতে ঘড়ির কাঁটায় ১২টা বেজেছে। পরিবারের সদস্যরাও তার ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে আসলেন। বিদায় নিয়ে টুঙ্গিপাড়ার পথে রওনা হলেন রশিদ।

পথ হাঁটতে হাঁটতে অশ্রুসজল নয়নে রশিদের ছোট মেয়ে জুলেখা বেগম বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা থেকে এখনো বৃদ্ধ বয়সেও বাবা একা একা ১৫ আগস্ট টুঙ্গিপাড়া মাজারে যান। এত দূরের পথ যেতে আমরা তাকে বারণ করলেও শোনেন না।’

মেয়েকে থামিয়ে দিয়ে রশিদ বলেন, ‘মা-রে ১৫ আগস্ট আমাকে টুঙ্গিপাড়া থাকতেই হবে। আগামী বছর বেঁচে থাকি না মরে যাই বলা তো যায় না। তবে মরার আগে একটা ইচ্ছা, বিদেশে থাকা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারটা যেন দেখে যেতে পারি।’

বৃহস্পতিবার (১৫ আগস্ট) সকালে টুঙ্গিপাড়া পৌঁছেছেন বলে মোবাইল ফোনে বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন আব্দুর রশিদ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর