খুলনার উপকূলীয় অঞ্চলে লবণ সহিষ্ণু পাট চাষে সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে সুন্দরবন সংলগ্ন খুলনা জেলার উপকূলীয় তিন উপজেলায় লবণ সহিষ্ণু পাট চাষে ব্যাপক সফলতা মিলেছে। প্রথমবারের মতো ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকরাও বেশ খুশি।
জানা গেছে, কৃষি অধিদপ্তর লবণাক্ত জমিতে বাণিজ্যিকভাবে বিজেআরআই-৮ জাতের পাট চাষ ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। কৃষি কর্মকর্তারা আশা করছেন, উপকূলীয় এলাকায় দেশের প্রচলিত পাট চাষের তুলনায় নতুন জাতের পাট চাষে খরচ কম পড়বে এবং উৎপাদনও বেশি হবে।
জানা গেছে, গত শতকের পঞ্চাশের দশকের পর খুলনা অঞ্চলে গড়ে ওঠে একাধিক পাটকল। বৃহত্তর খুলনার পার্শ্ববর্তী জেলা যশোর-ফরিদপুর, কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাট চাষ হলেও লবণাক্ততার করণে উপকূলীয় জেলা খুলনাতে বাণিজ্যিকভাবে পাট চাষ হয়নি। ফলে লোকসানে পড়ে খুলনা অঞ্চলের সরকারি-বেসরকারি অনেক পাটকল বন্ধ হয়ে যায়।
পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট ও কৃষি অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে খুলনার উপকূলীয় এলাকার লবণাক্ত আবাদী-অনাবাদী জমিতে পাট চাষের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর গবেষণার মাধ্যমে বিজেআরআই-৮ সহ লবণ সহিষ্ণু বেশ কয়েকটি পাটের নতুন জাত উদ্ভাবন করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছর খুলনার উপকূলীয় উপজেলা দাকোপ, পাইকগাছা ও ডুমুরিয়া উপজেলার শতাধিক কৃষকের মাঝে বিজেআরআই-৮ জাতের বীজ বিতরণ করে কৃষি অধিদপ্তর। প্রথম বারের মতো লবণসহিষ্ণু এ পাটের চাষ করে ভালো ফলন পেয়েছেন কৃষকরা। রোগ-বালাই কম এবং ফলন বেশি হওয়ায় খুশি তারা।
কৃষি অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের উপকূলীয় ১০ দশমিক ৫৬ লাখ হেক্টর জমি বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ততায় কবলিত। এসব জমিতে লবণ সহিষ্ণু বিজেআরআই-৮ জাতের পাট চাষ সহায়ক হবে। এর ফলে কৃষকরাও আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হবেন।
ডুমুরিয়া উপজেলার দক্ষিণ ডুমুরিয়া গ্রামের কৃষক মোশাররফ হোসেন কচি জানান, এ বছর তিনি একবিঘা জমিতে নতুন বিজেআরআই-৮ জাতের পাট চাষ করে ভালো ফলন পেয়েছেন। একটি পাটও নষ্ট হয়নি। অপরদিকে একই সঙ্গে আরো ২-৩ বিঘা জমিতে ভারতীয় জাতের পাট চাষ করলেও অর্ধেক নষ্ট হয়ে গেছে।
একই গ্রামের কৃষক মুরাদ হোসেন জোয়ার্দার জানান, এতদিন ভালো জাতের পাটের না পাওয়ায় উপকূলীয় অঞ্চলে পাট চাষ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। তবে এ বছর উপকূলীয় এলাকায় নতুন বিজেআরআই-৮ জাতের পাট চাষ ভালো হওয়ায় তিনি উৎসাহিত হয়েছেন এবং আগামী বছর থেকে তিনিও এ জাতের পাট চাষ করবেন।
কৃষিতে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ডুমুরিয়া উপজেলার খর্ণিয়া গ্রামের কৃষক হানিফ শেখ জানান, আমন ধান চাষের আগ পর্যন্ত এই অঞ্চলের অধিকাংশ জমি লবণাক্ত ও জলাবদ্ধতার কারণে পতিত থাকে। এসব পতিত জমিতে বিজেআরআই-৮ জাতের পাট চাষ শুরু হয়েছে। তাই আমন মৌসুমের আগে অর্থকরী ফসল হিসাবে কৃষকরা এই পাট চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।
ডুমুরিয়া উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা রণজিৎ কুমার বালা বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে বলেন, ‘বিজেআরআই-৮ জাতের পাট দেশের প্রচলিত পাটের তুলনায় বেশি লম্বা এবং আঁশও বেশি। এই পাট লম্বায় ১৫ ফুট পর্যন্ত হয়। লবণাক্ত এলাকায় অন্য জাতের পাট যখন মারা যাচ্ছে, তখন এই জাতের পাট থাকছে সবুজ ও সতেজ।’
ডুমুরিয়া উপজেলার খর্ণিয়া ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ইকবাল হোসেন বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে বলেন, আমার ইউনিয়নের যে কয়েকজন কৃষক বিজেআরআই-৮ জাতের পাট চাষ করেছেন, তারা বিঘা প্রতি ১৪-১৬ মণ পাট পেয়েছেন। যা অন্য জাতের ফলনের চেয়ে ৪-৬ মণ বেশি। ফলে তারা পাট বিক্রি করে বিঘা প্রতি ৬-৮ হাজার টাকা বেশি আয় করেছেন।’
ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোসাদ্দেক হোসেন বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে বলেন, ‘লবণ সহিষ্ণু পাট নিয়ে ২০১৫ সালে শুরু হওয়া গবেষণার সাথে আমি যুক্ত। এ বছর মাঠ পর্যায়ে ৪৬ জন কৃষককে ৪৬ বিঘা জমিতে এই পাট চাষে উদ্বুদ্ধ করেছি। যাদের প্রত্যেকে ভালো ফলন পেয়েছেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘বিজেআরআই-৮ জাতের পাট ১০ মাত্রার লবণাক্ততা সহিষ্ণু জলাবদ্ধ স্থানেও বৃদ্ধি পায়। এছাড়া এই জাতের পাট খরা সহিষ্ণুও। দেশের প্রচলিত জাতের পাটের তুলনায় এই পাট বেশি তেঁতো হওয়ায় রোগ-বালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণের শিকারও কম হয়। ফলে এই পাট চাষে বালাইনাশক লাগে না বললেই চলে। ফলে উৎপাদন খরচও কমে যায়।’