ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা জহুরা খাতুনের শরীর চলতে চায় না, তবুও তিনি চালিয়ে যান। কখনও লাঠিতে ভর দিয়ে কখনও পা টেনে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ভিক্ষাবৃত্তি করতে ছুটে চলেন এ বাড়ি ও বাড়ি। হাঁটতে হাঁটতে হাঁপিয়ে ওঠেন জহুরা। একটু জিরিয়ে ফের শুরু করেন পথচলা।
গৌরীপুরের রামগোপালপুর ইউনিয়নের নওগাঁও গ্রামের একটি ভাঙাচোরা ঘরে জহুরার বসবাস। বাবা মৃত উমর আলী। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে জহুরা তৃতীয়।
মঙ্গলবার (০৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে জহুরা খাতুনের দেখা মিলে নওগাঁও গ্রামে। তার এক হাতে লাঠি আরেক হাতে ব্যাগ। ভিক্ষাবৃত্তি করতে ছুটছেন বাড়ি বাড়ি। কোথাও সাহায্য মিলছে, কোথাও ফিরতে হচ্ছে খালি হাতে।
ভিক্ষাবৃত্তি শেষে বাড়ি ফিরলে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় জহুরা খাতুনের। আলাপে উঠে আসে তার জীবনের পাওয়া না পাওয়ার নানা গল্প। তিনি বলেন, ‘আমি জন্ম থেইকা প্রতিবন্ধী না। ছোটবেলায় বাতাস লাইগা আমার বাম হাত ও বাম পা বেঁইকা যায়। হের পর থেইকা খুঁড়াইয়া চলি। অভাবের লেইগা বাপ-মায় চিকিৎসা করায় নাই। অহন গেরামের মাইনষে আমারে লুলি ফহিন্নি কইয়া ডাকে।’
স্বাধীনতার পর জহুরার বাবা-মা মারা যান। এরপর তার বিয়ে হয় গ্রামেরই এক ব্যক্তির সঙ্গে। কয়েকদিন সংসার করার পর স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যান। এরপর আর খোঁজ নেননি। অভাবের তাড়নায় ভাইয়েরাও মুখ ফিরিয়ে নেন। শুরু হয় নিঃসন্তান জহুরার জীবন সংগ্রাম। শেষ বয়সে বয়স্ক ভাতার কার্ড পেলেও চাহিদার তুলনায় সেটা নিতান্তই অপ্রতুল।
জহুরা খাতুন বলেন, ‘প্রতিবন্ধী বইলা আমারে কেউ কামে নেয় না। তাই ভিক্ষা শুরু করি। কিন্ত গেরামের মানুষ চাল ভিক্ষা দেয়, টাকা দেয় না। তরিতরকারি কিনতে পারি না। শাকপাতা টুকাইয়া রাইন্ধা ভাতের লগে খাই।’
জহুরা খাতুনের বাম হাত অচল হওয়ায় ঘর-গৃহস্থালির সব কাজ তিনি ডান হাতে করেন। এক সময় গ্রামে গ্রামে ভিক্ষাবৃত্তি করতেন জহুরা। কিন্তু বয়সের ভারে এখন তার ভিক্ষাবৃত্তি প্রতিবেশীদের বাড়িতেই সীমাবদ্ধ। রান্নার জ্বালানির জন্য তাকে ঝোপঝাড় থেকে পাতা কুড়াতে হয়।
জহুরা খাতুন বলেন, ‘আমি রোগ-পীড়ায় ভুগি, চিকিৎসা করাইতারি না। ঘরডাও ভাইঙা পড়তাছে। মেঘের পানিত সব ভিজা যায়। একটা কল নাই, ল্যাট্টিন নাই। একহাতে সব কাম করা লাগে। মাঝে মইধ্যে কাপড় ধুইতে গিয়া পুস্কুনিত পইড়া যাই। মাইনষে টাইনা তোলে। কোনদিন যে ডুইবা মরি কে জানে!’
জহুরার গল্প শুনতে শুনতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। এমন সময় আগমন ঘটে প্রতিবেশী রহিছা বেগমের। তিনি বলেন, ‘জহুরা তিনবেলা খাইতারে না, পড়তারে না। ঘরডাও ভাইঙা পড়তাছে, ঠিক করতারে না। বান-তুফানে যে কোনদিন ঘরডা ভাইঙা পড়ে আল্লায় জানে!’
রহিছার কথা টেনে নিয়ে জহুরা বলেন, ‘খাওয়া-পড়া লইয়া আমার কোন দাবি নাই। দাবি আমার একটাই নতুন একটা ঘর চাই।’