ময়মনসিংহ রেঞ্জে শ্রেষ্ঠ পুলিশ সুপার হয়েছেন চারবার। এবার নিজের মেধা ও যোগ্যতায় তথ্য-প্রযুক্তিতে শেরপুর জেলাকে নিয়ে গেলেন শীর্ষে। দেশের সব জেলার মধ্যে ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি) চালুর মাধ্যমে নতুন এক ইতিহাস গড়লেন শেরপুরের পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম।
যখন বালিশ ও পর্দা কেনাকাটায় তুঘলকি কাণ্ড নিয়ে আলোচনা শীর্ষে, ঠিক তখনই জেলা পুলিশের সব ধরনের কেনাকাটায় ই-জিপি চালু করে তিনি রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) শেরপুর জেলা পুলিশের কেনাকাটায় ই-জিপি চালু করেন কাজী আশরাফুল আজীম।
সরকারের ক্রয় আইন, ২০০৬ এর ৬৫ নং ধারা অনুযায়ী ই-জিপি নীতিমালা অনুমোদন হয়েছে বহু আগেই। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ২০০৬ এর ধারা ৬৭ এবং পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ এর বিধি-১২৮ অনুসরণে প্রণীত এবং জারিকৃত ‘ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি) নির্দেশমালা’ মেনে সরকারি তহবিলের অর্থ দিয়ে যেকোন পণ্য, কাজ বা সেবা ক্রয়ের ক্ষেত্রে ই-জিপি পদ্ধতি ব্যবহারে বাধ্যবাধকতাও রয়েছে।
কিন্তু এই বিধি অনুসরণে অনেকেই ছিলেন নাখোশ। কারণ এতে দুর্নীতি আর হরিলুটে যেমন প্রতিবন্ধকতা তেমনি পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দিয়ে কমিশন হাতিয়ে নেওয়া কিংবা টেন্ডারবাজির মাধ্যমে কাজ নেওয়ার সুযোগও হাত ছাড়া হওয়ার শংকা ছিলো বহু গুণে।
এবার বাংলাদেশের সব জেলাকে ছাপিয়ে পুলিশ সুপার হিসেবে নিজেই উদ্যোগ নিয়ে চালু করলেন ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি)।
এ প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম বলেন, সরকারি অর্থ প্রকৃত পক্ষে জনগণেরই অর্থ। আর সেই অর্থের অপচয় রোধ করতে টেন্ডারিং প্রক্রিয়ায় শতভাগ স্বচ্ছতা আর সততা বজায় রাখার স্বার্থেই সরকার ডিজিটাল পদ্ধতিতে চালু করে ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি)।
এর ফলে লাইনে দাঁড়িয়ে ক্যাডার বাহিনী নিয়ে আর টেন্ডার জমা দিতে হবে না। পছন্দের কাউকে কাজ দেবার অনুরোধ বা তদবির করার সুযোগ থাকছে না। অনলাইনে টেন্ডার দাখিলের সুবিধা প্রবর্তনের ফলে দরপত্র ছিনতাই বা প্রভাব বিস্তারের কোন সুযোগ থাকছে না। এটাই কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা। এই প্রক্রিয়া জেলা পর্যায়ে প্রথমবারের মতো শুরু করতে পেরে নিজেকে গর্বিত বোধ করছি—জানান পুলিশের ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তা কাজী আশরাফুল আজীম।
সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিইউ) সূত্র বলছে, ২০১১ সালের ২ জুন ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি) পোর্টালটির সুইচ টিপে আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সরকারি ক্রয় কাজে দুর্নীতি, অনিয়ম ও টেন্ডারবাজি ঠেকাতে ই-টেন্ডারিং প্রবর্তন করা হলেও এখনও পুরোপুরি তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। যে কারণে রূপপুরে বালিশকাণ্ড বা ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পর্দা আর বই কেনাকাটায় সাগর চুরির মতো দুর্নীতির ঘটনা এখন সবার মুখে মুখে।
উন্নয়ন কার্যক্রমকে আরও গতিশীল এবং সরকারি অর্থ ব্যয়ে অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ই-টেন্ডারিং ব্যবস্থা প্রবর্তন বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে নিজের উদ্যোগের কথা জানিয়ে পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, আমরা মুখে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের কথা বলি। কিন্তু কাজে যদি সনাতনী পদ্ধতি অবলম্বন করি তাহলে তো দেশ এগুবে না।
এখন ঠিকাদারকে আর কারও সঙ্গে দরদাম করার সুযোগ নেই। ঘরে বসেই নিরাপদে জমা দিতে পারবেন নিজের টেন্ডার। www.eprocure.gov.bd এই পোর্টালে প্রবেশ করে নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করার মাধ্যমে ই-জিপি সিস্টেমে প্রকাশিত ই-টেন্ডারিংয়ে অংশ নিতে পারবেন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার। দরপত্রদাতা/ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান/ ব্যক্তি পরামর্শক/ সরকারি মালিকানাধীন এন্টারপ্রাইজসমূহ নিবন্ধন প্রক্রিয়া সফলভাবে সম্পূর্ণ করার পরই একজন দরদাতা হিসেবে ই-জিপি সিস্টেমের ড্যাশবোর্ডে প্রবেশ করতে পারবেন এবং ই-জিপি সিস্টেম ব্যবহার করে ই-টেন্ডারিংয়ে অংশ নিতে পারবেন। এর মাধ্যমে সরকারি কেনাকাটায় স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।
এর অংশ হিসেবে প্রায় অর্ধ কোটি টাকার কেনাকাটার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্টের (ই-জিপি) ইতিহাসে জেলা পুলিশ হিসেবে প্রথম নাম লেখালো শেরপুর।
শেরপুরের নাগরিক সমাজের একাধিক প্রতিনিধি জানান, এর আগেও জেলার শীর্ষ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে গণশুনানির আয়োজন করে দুর্নীতি দমন কমিশন। সেখানে একমাত্র জেলা পুলিশ বাদে প্রায় সব সরকারি দফতরের সেবা ও নাগরিক সুবিধা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষরা। অথচ অতীতে দেখা গেছে পুলিশের সেবা নিয়েই গণশুনাণিতে বেশি প্রশ্ন তুলতেন নাগরিকরা।
মহিলা পরিষদের চেয়ারম্যান জয়শ্রী দাস লক্ষ্মী বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে জানান, জেলা পুলিশকে দুর্নীতিমুক্ত রাখার ঘোষণা দিয়ে শেরপুরে যোগ দেন কাজী আশরাফুল আজীম। ৩০ লাখ শহীদ স্মরণে জেলায় ৩০ লাখ গাছের চারা লাগিয়েও আলোচনায় আসেন তিনি। পুলিশ সুপার হিসেবে কাজী আশরাফুল আজীম দায়িত্ব গ্রহণের পর সেবার মান বেড়েছে। বদলেছে পুলিশের কার্যক্রমের ধারা।
আগের চাইতে পুলিশ এখন অনেক জনমুখী। সেবার মানও উন্নত। দ্রুত সেবা গ্রহণ, মামলার তদন্তে পুলিশের আন্তরিকতাও এখান অনেকে বিস্তৃত, বলেন জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট নারায়ণ চন্দ্র হোড়।
কর্তব্যনিষ্ঠা, সততা ও উন্নয়নসহ ভালো কাজের জন্য চলতি বছর বাংলাদেশ পুলিশের সর্বোচ্চ পদক পিপিএম সেবা (রাষ্ট্রপতি পুলিশ মেডেল) পুরস্কার অর্জন করেন কাজী আশরাফুল আজীম।
২০০৫ সালের ২ জুলাই পুলিশ বিভাগে যোগ দেওয়া পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম বলেন, পুলিশ জনগণের বন্ধু। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ পুলিশ আজ সেবা ও মানে অনেক পরিণত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী স্যারের নির্দেশ বাংলাদেশকে প্রকৃতপক্ষে ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপ দিতে হবে। আমি সেই প্রচেষ্টা নিয়েছি মাত্র। স্বপ্ন দেখি তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমেই এ দেশ হবে জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ।