বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ’র (এনটিআরসিএ) সনদ জাল করে ৯ বছর বাংলা বিষয়ে প্রভাষক পদে চাকরি করার পর ধরা পড়েছেন পাবনার ভাঙ্গুড়ার হাজী জামাল উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক নাজনীন নাহার। এনটিআরসিএ জাল সনদধারী শিক্ষকের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করার নির্দেশনা দিলেও কলেজ কর্তৃপক্ষ ওই শিক্ষকের স্বামী ক্ষমতাসীন দলের নেতা হওয়ায় গড়িমসি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, হাজী জামাল উদ্দিন ডিগ্রি কলেজে ২০১০ সালে প্রভাষক নিয়োগের চূড়ান্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ওই পরীক্ষায় বাংলা বিষয়ের প্রভাষক পদে আবেদন করেন এবং পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে গেলে নিয়োগ বোর্ডের সংশ্লিষ্টদের এনটিআরসির নিবন্ধন সনদ জাল সন্দেহ হলে তাকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু ভাঙ্গুড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল হাই বাচ্চু প্রভাব খাটিয়ে তার স্ত্রীকে পরীক্ষায় বসানোর ব্যবস্থা করেন।
অভিযোগ উঠে, ওই সময়ে এ আওয়ামী লীগ নেতা কলেজ পরিচালনা পর্ষদ ও নিয়োগ বোর্ডকে অনৈতিকভাবে ম্যানেজ করেন। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় নিয়োগ বোর্ড শিক্ষক নিবন্ধন জাল সনদেই নিয়োগ দেন নাজনীন নাহারকে।
একটি সূত্র জানায়, জাল শিক্ষক নিবন্ধন সনদে নিয়োগ দেওয়ার সময় কলেজের সাধারণ শিক্ষকদের মধ্যে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সে সময়ে নিয়োগ বোর্ড কলেজ কর্তৃপক্ষকে নিয়োগকৃত নাজনীন নাহারের নিবন্ধন সনদ যাচাইয়ের জন্য পরামর্শ দেয়। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ তার নিবন্ধন সনদ যাচাই বাছাই না করায় তিনি বহাল তবিয়তে ৯ বছর ধরে চাকরি করে আসছিলেন।
অপর একটি সূত্র জানায়, প্রভাষক পদে নিয়োগ পাওয়া নাজনীন নাহারের এমপিওভুক্তির সময় তার নিবন্ধন সার্টিফিকেট যে জাল সেটা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের এমপিও (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) শাখায় ধরা পড়ে। সেখানেও অনৈতিক পন্থায় সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ম্যানেজ করে এমপিওভুক্ত করানো হয়। ওই প্রভাষকের সনদ জাল এটি কলেজের বিভিন্ন সময়ের সরকারি অডিটে (নিরীক্ষা) উঠে আসলেও বারংবার ঘুষ দিয়ে তিনি এমপিও বহাল রাখেন। গেল ৯ বছরে জাল সনদে তিনি সরকারের ২৩ লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালে কলেজ জাতীয়করণের ঘোষণা আসার পর শুরু হয় শিক্ষকদের সনদসহ প্রয়োজনীয় ফাইল যাচাইবাছাই। গেল বছরের ১২ আগস্ট সরকারিকরণ জিও (গভর্নমেন্ট অর্ডার) জারির পর এনটিআরসিএ ১ম থেকে ৫ম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নিবন্ধন যাচাইয়ের জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষকে তলব করে। সে সময়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ নিয়োগপ্রাপ্ত ১৭ শিক্ষকের নিবন্ধন সনদ এনটিআরসিএ ’র কাছে পাঠায়। যাচাই বাছাই শেষে চলতি বছরের ৫ সেপ্টেম্বর নাজনীন নাহারের নিবন্ধন সনদ জাল বলে সংশ্লিষ্ট কলেজে চিঠি পাঠায়। একই কপি ভাঙ্গুড়া থানায় পাঠিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষকে নাজনীন নাহারের বিরুদ্ধে মামলা করার নির্দেশ দেন।
বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, হাজী জামাল উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সনদটি অধিকতর যাচাইয়ের জন্য গত সপ্তাহে ঢাকার বিভিন্ন অফিসে খোঁজ খবর নিয়ে জাল সনদের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন। অথচ তিনি অজ্ঞাত কারণেই অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রায় তিন সপ্তাহেও কোন আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় জনমনে দেখা দিয়ে নানা প্রতিক্রিয়া।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কলেজের কয়েকজন শিক্ষক জানান, দুর্নীতি শুরুতেই করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠান প্রধানের প্রশ্রয়ে এবং নিয়োগ বোর্ডকে আর্থিক ম্যানেজ করে জাল সার্টিফিকেট ধারীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যা চরম অন্যায়ের সামিল। প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা হওয়ার কারণেই এবং অনাকাংখিত ঝামেলা এড়াতে আমরা কোন প্রতিবাদ করতে পারিনি। তাদের দাবি, অভিযুক্ত শিক্ষকসহ এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত প্রত্যেকের কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত।
এনটিআরসিএ’র প্রতিবেদনে জাল সনদধারী শিক্ষক নাজনীন নাহারের মোবাইলে একাধিকবার ফোন দিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ধরেননি।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অধ্যক্ষ শহীদুজ্জামান অনৈতিক ভাবে জাল সনদের শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ১ম থেকে ৫ম পর্যন্ত এনটিআরসিএ’র সনদ পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। পরবর্তীতে শিক্ষক নাজনীন নাহারের নিবন্ধন সনদ জাল এমন প্রতিবেদন আসার সাথে সাথেই তাকে নোটিশ করা হয়েছে। কিন্তু তিনি কলেজ আর না এসে নিজে থেকেই অব্যাহতিপত্র কলেজে পাঠিয়েছেন।
অধ্যক্ষ আরো বলেন, ডিজি অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তাদের পরামর্শ মোতাবেক পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
কলেজের সভাপতি ভাঙ্গুড়া ইউএনও সৈয়দ আশরাফুজ্জামান বলেন, জাল সনদে ৯ বছর ধরে সরকারি বেতন ভোগ করেছেন। সরকারি টাকা ফেরতসহ তার বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ কলেজ কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই নিতে হবে।