কবি শেখ ফজলল করিমকে এখন কেউ স্মরণ করেন না

লালমনিরহাট, দেশের খবর

নিয়াজ আহমেদ সিপন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, লালমনিরহাট | 2023-09-01 23:21:32

‘‘কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক...কে বলে তা বহুদূর/মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেতে সুরাসুর...।” এই অমর বাণীর রচয়িতা কবি শেখ ফজলল করিমকে এখন আর কেউ স্মরণ করেন না। গত ২৮ সেপ্টেম্বর এই মহান কবির ৮৩তম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল। কিন্তু নিরবে-নিভৃতেই কেটে গেল দিনটি। পরিবার বা প্রশাসনের কেউ তার স্মরণে নূন্যতম দোয়া মাহফিল করেনি। এ আক্ষেপ প্রকাশ করে কলেজের ছাত্ররা স্থানীয় মসজিদে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে।

জানা গেছে, প্রতিবছর কবি শেখ ফজলল করিম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে কবির মৃত্যুবার্ষিকীতে মিলাদ মাহফিল ও রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়। কিন্তু এ বছর কিছু করা হয়নি।

বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানিয়েছেন, গত শুক্রবার নজরুল উৎসব হওয়ায় কবির মৃত্যুবার্ষিকীতে কোনও আয়োজন করেনি বিদ্যালয়ের কৃর্তপক্ষ।

প্রধান শিক্ষক মাহবুবুল আলম খোকন জানান, পরবর্তীতে কবির মৃত্যুবার্ষিকীর মিলাদ মাহফিল করা হবে।

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) রবিউল হাসান বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে বলেন, ‘কবির মৃত্যুবার্ষিকী পালনের জন্য সরকারিভাবে কোনও নির্দেশনা ছিল না। ডিসি মহোদয়ও কিছু বলেন নি। তবে একজন প্রথিতযশা কবির জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী সরকারিভাবেই পালন হওয়া দরকার।’

জানা গেছে, ১৯৯৩ সালে লালমনিরহাট-বুড়িমারী মহাসড়কের পাশে কবির স্মৃতির উদ্দেশে ছোট্ট একটি স্মৃতিফলক তৈরি করা হয়। এটি কবির বাড়ির দিক নির্দেশনা হিসেবে কাজ করে। জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনায় কবির স্মৃতি বিজড়িত গ্রামের বাড়িটিতে গিয়ে দেখা গেছে, ২০০৫ সালে কবির স্মৃতি রক্ষার্থে কাকিনা বাজারে দ্বিতল ভবনে নির্মিত শেখ ফজলল করিম পাঠাগারটি এখন আবর্জনার স্তুপে পরিণত হয়েছে। নেই কোনও নিরাপত্তা প্রহরী, নেই পাঠক, যেসব বই-পুস্তক ছিল সেগুলোও হারিয়ে যেতে বসেছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, কিছুদিন আগে পাঠাগারটি অস্থায়ী ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে সেখানে বই প্রেমীরা যান না। আর রাতে সেখানে মাদকসেবীরা পদচারণা থাকে।

আরও জানা গেছে, পাঠাগারটি দেখভালের জন্য উপজেলা প্রশাসন থেকে স্থানীয় আজিমুদ্দিন নামের এক ব্যক্তিকে এক হাজার টাকা সম্মানীতে নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে একটি টাকাও সম্মানি পাননি আজিমুদ্দিন।

কবি শেখ ফজলল করিম স্মৃতি পাঠাগারের সভাপতি ও কাকিনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম জানান, ঢাকায় থাকায় মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা সম্ভব হয় নি।

সরেজমিনে কবির বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, আগের কাঠের বাড়িটি আর নেই। সেখানে পাকা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। রুমের ভেতরে ভাঙা চৌকাঠ পড়ে আছে। সৌখিন কারুকাজ করা কাঠগুলো উঁইপোকায় খেয়ে ফেলায় খসে খসে পড়ছে। চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে যেতেই চোখে পড়ে কাঠের দেয়ালজুড়ে কবির বেশ বড় দুটো ছবি। আরও আছে কবির ব্যবহৃত জীর্ণ একটি চেয়ার, খাট ও একটি গ্রামোফোন। ঘরটির এক কোণে আছে কাঁচের একটি শোকেস। শোকেসের কাঁচগুলো ভাঙা। ভেতরে আছে কবির ব্যবহৃত টুপি, দোয়াত-কলম, ছোট্ট কোরআন শরীফ, ম্যাগনিফাইং গ্লাস ও কিছু বোতাম।

কবি বাড়ির বর্তমান রক্ষক তার নাতি ওয়াহিদুন্নবী জানান, কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল কবির বাড়ি। সেটি ভেঙে পাকা করে একটি রুমে রাখা হয়েছে কবির জিনিসপত্র। দীর্ঘদিন এমনি পড়ে থাকায় কবির ব্যবহৃত জিনিসগুলো নষ্ট হতে শুরু করেছে।

জানা গেছে, কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনায় অজোপাড়াগায়ে ১৮৮২ সালের ১৪ এপ্রিল সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন কবি শেখ ফজলল করিম। ১৩ বছর বয়সে পার্শ্ববর্তী বিনবিনা গ্রামের গনি মোহাম্মদ সর্দারের মেয়ে বসিরন নেছার সাথে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পরের বছর ‘এন্ট্রাস’ পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন তিনি। পরবর্তীতে কবির বৈচিত্রময় রচনায় ফুটে উঠেছে সমসাময়িক ঘটনা, চিন্তা-চেতনা, ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, সমাজ সংস্কার ও নারী শিক্ষাসহ সমাজ পরিবর্তন ও মননশীলতা অঙ্গীকার।

উপমহাদেশের প্রথম কাকিনার মতো অজপাড়াগাঁয়ের নিজ বাড়িতে কবি স্থাপন করেছিলেন ‘শাহবিয়া প্রিন্টিং ওয়ার্কস’ নামের একটি ছাপাখানা। এছাড়া তিনি ৫৫টির অধিক বই লিখেছেন। বইগুলোর মধ্যে ‘লাইলী মজনু’ ‘শিরি ফরহাদ’ ‘বিবি খাদিজা’ ‘মহর্ষি রাবেয়া’ উল্লেখযোগ্য।

উপদেশমূলক রচনা ‘পথ ও পাথেয়’ গ্রন্থের জন্য তিনি পেয়েছিলেন রৌপ্য পদক। বাংলা ১৩২৩ সনে ভারতের নদীয়া সাহিত্য পরিষদ তাকে সাহিত্য বিশারদ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৩৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর এই প্রথিতযশা কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর