প্রতিনিয়ত চুরি হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনের সিগন্যালিং ব্যবস্থার মূল্যবান তার ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এ স্টেশনে নেই কোনো নিরাপত্তাকর্মী। পাশাপাশি রাতেও থাকে না কোনো পুলিশ কিংবা প্রহরী। যার কারণে প্রায়ই স্টেশনে ঘটে ছিনতাই ও চুরির ঘটনা। আর এতে করে রাতের বেলায় অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে স্টেশনটি।
অন্যদিকে ২১ জন জনবলের বিপরীতে স্টেশনটিতে মাস্টারসহ আছেন মাত্র চারজন কর্মকর্তা ও কর্মচারী। লোকবলের অভাবে ও সিগন্যালের তার চুরির কারণে আড়াই মাস যাবত বন্ধ রয়েছে স্টেশনের সিগন্যালিং ব্যবস্থা। পাশের ভৈরব ও তালশহর স্টেশনের সিগন্যাল দিয়ে কোনোভাবে চলছে স্টেশনটি। সিগন্যাল ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ার কারণে ট্রেনগুলো ইচ্ছামতো থামছে আবার থামছে না। এতে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বিভিন্ন সমস্যার কারণে স্টেশনটি ডি ক্যাটাগরির স্টেশনে পরিণত হয়েছে। এতে করে ফুঁসে উঠছে আশুগঞ্জের স্থানীয়রা।
আশুগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনের লোকজন ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের অন্যতম শিল্প ও বন্দরনগরী এবং গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানসমৃদ্ধ আশুগঞ্জ রেল স্টেশনে যাত্রী চাহিদা থাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট-নোয়াখালী-চাঁদপুর রেলরুটে চলাচলকারী তিনটি আন্তঃনগর ট্রেনসহ বেশ কয়েকটি মেইল ট্রেনের নির্ধারিত যাত্রা বিরতি রয়েছে। প্রতিদিন এ স্টেশন দিয়ে বিভিন্ন রুটে হাজারো যাত্রী যাতায়াত করেন। স্টেশনে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় স্টেশন ও সেতু এলাকায় প্রতিদিনই ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন যাত্রী ও সাধারণ জনগণ। দিনের বেলায় চারজন বিভিন্ন বিভাগে কাজ করলেও রাতের বেলায় পুরোপুরি অরক্ষিত হয়ে পড়ে স্টেশনটি। লোকবলের অভাবে স্টেশনটির সব বিভাগ ঝিমিয়ে পড়েছে। এতে করে কমেছে যাত্রী সেবার মান।
স্টেশনটি থেকে দৈনিক প্রায় ৮০ হাজার টাকা আয় হলেও এই টাকা নিয়েও বিপাকে পড়তে হয় কর্মকর্তাদের। এছাড়া এই স্টেশন থেকে বছরে কোটি টাকা রাজস্ব পায় সরকার। চলতি বছরের জুলাই মাসে ১৪ হাজার ২৩৪ জন যাত্রীর কাছ থেকে আয় হয়েছে ১৮ লাখ ৯৯ হাজার ৭ টাকা, আগস্ট মাসে ১৪ হাজার ৯০৮ জন যাত্রী থেকে আয় হয়েছে ১৯ লাখ ৯ হাজার ৮৫ টাকা। পাশাপাশি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এই স্টেশন থেকে চলাচল করেছেন এক লাখ ২১ হাজার ৮৭৭ জন যাত্রী। তাদের কাছ থেকে এক কোটি ৪৫ লাখ ৯৯ হাজার ৮২৬ টাকা আয় হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চলাচল করেছেন এক লাখ ৭৩ হাজার ৫৭১ জন যাত্রী। তাদের কাছ থেকে আয় হয়েছে দুই কোটি ৫৯ লাখ ৩৯ হাজার ১৩৩ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চলাচল করেছে এক লাখ ৯৩ হাজার ৯১ জন যাত্রী। তাদের কাছ থেকে আয় হয়েছে দুই কোটি ৫৯ লাখ ৩৯ হাজার ১১৩ টাকা।
স্টেশন কর্তৃপক্ষের দাবি, স্টেশনে সরকার নির্ধারিত ২১টি পদের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন মাত্র চারজন। স্টেশন মাস্টার চারজনের বিপরীতে আছেন একজন, গুডস সহকারী তিনজনের বিপরীতে একজন, বুকিং সহকারী চারজনের বিপরীতে একজন ও সিলম্যান আছেন একজন। পোর্টার পদে তিনজন থাকার কথা থাকলেও একদমই শূন্য রয়েছে পদটি। পয়েন্টসম্যান তিন জন থাকার কথা থাকলেও খালি পড়ে আছে এ পদ। টালিক্লার্ক তিন জনের বিপরীতে কেউ নে। সবমিলিয়ে, ২১ জনের পদ থাকলেও এখানে কর্মরত আছেন মাত্র চারজন। যার কারণে যাত্রী সেবার মান কমেছে। এছাড়াও রাতের বেলা স্টেশনে নিরাপত্তাকর্মীসহ কোনো লোক না থাকয় অহরহ ঘটছে চুরি ছিনতাইয়ের ঘটনা।
স্টেশনে গাড়ির জন্য অপেক্ষায় থাকা যাত্রী মো. মাইনুল হোসেন বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে জানান, আশুগঞ্জ স্টেশনের গ্রেডিং ও যাত্রী সেবার মান উন্নয়নে স্থানীয় জনগণ আন্দোলন করেছিলেন। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সব বিষয় সমাধানের আশ্বাস দিয়েছিল। স্থানীয় জনগণের চাহিদা বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ এসব বিষয়ে দ্রুত সমাধান করবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
আরেক যাত্রী ফরহাদ মিয়া বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে জানান, স্টেশনে রাতে ও দিনের বেলায় সাধারণ জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য নিরাপত্তাকর্মী দেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি স্টেশনটিতে যাত্রী সেবার মান বাড়ানো দরকার।
স্টেশন মাস্টার মো. নুর নবী বলেন, 'স্টেশনটিতে নির্ধারিত ২১ জন জনবলের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র চারজন। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে সিগন্যাল ব্যবস্থার তার চুরি ও জনবল না থাকার কারণে আড়াই মাস যাবৎ সিগন্যালিং ব্যবস্থা পুরোপুরি বন্ধ আছে। বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করা হয়েছে।'
নিরাপত্তা না থাকায় নিজের শঙ্কার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আখাউড়া রেলওয়ে থানাকে এ বিষয়টি লিখিতভাবে একাধিকবার অবগত করা হয়েছে। এছাড়া জনবলের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে কয়েকবার চিঠি পাঠিয়েও কোন সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।'
এই বিষয়ে আখাউড়া রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শ্যামল কান্তি দাশ বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে বলেন, 'আশুগঞ্জ স্টেশনের মাস্টারের কাছ থেকে নিরাপত্তার জন্য পুলিশ চেয়ে দেওয়া একটি চিঠি আমরা পেয়েছি। সেটি পুলিশ সুপারের কাছে পাঠানো হয়েছে। দিনের বেলায় আমাদের তিনজন পুলিশ স্টেশনে কাজ করেন। জনবল স্বল্পতার কারণে রাতে সেখানে পুলিশ দেওয়া যাচ্ছে না। তবে কিছু পুলিশ সদস্য পাওয়া গেলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেখানে দেয়া হবে।'