আতঙ্কে স্কুলে যাচ্ছে না সাঁওতাল পল্লীর শিশুরা

বগুড়া, দেশের খবর

গনেশ দাস, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা টোয়েন্টিফোর.কম, বগুড়া | 2023-09-01 23:17:36

সাহেবগঞ্জ (বাগদা) সাঁওতাল পল্লী থেকে: হামলার আতঙ্কে বিদ্যালয়ে যেতে চাচ্ছে না গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ সাঁওতাল পল্লীর শিশুরা। ফলে শিক্ষার আলো থেকে তাদের বঞ্চিত হতে হচ্ছে।

জানা গেছে, সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম চত্বরে অবস্থিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে সুগার মিলে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানরা। ২০১৬ সালের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনার পর থেকে তারা একে অপরকে প্রতিপক্ষ মনে করে। স্কুলে গেলে তাদের ওপর হামলা হতে পারে। এই আতঙ্কে স্কুলে যেতে চায় না তারা।

স্কুলে যেতে না চাওয়ার অবশ্য আরো একটি কারণ রয়েছে। সেটি হলো দূরত্ব। বাগদা ফার্ম চত্বরে যে স্কুল সেটি সাঁওতাল পল্লী থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে। সাপমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে আরো একটি স্কুল থাকলেও সেটি সাঁওতাল পল্লী থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। ভ্যান ও রিকশা চলাচলের মত কোন রাস্তা না থাকায় শিশুরা পায়ে হেঁটে দূরের স্কুলে যেতে চায় না।

উপায় না দেখে সাঁওতাল পল্লীর বাসিন্দারা নিজেদের উদ্যোগে একটি স্কুল গড়ে তুলেছে। কিন্তু তেমন কোন আসবাবপত্র নেই, টিনের একটি ঘরে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম।

স্কুলে দেড় শতাধিক সাঁওতাল শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষা দিচ্ছেন চারজন শিক্ষক। বিনা বেতনে কর্মরত এই চারজন শিক্ষক স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে যাচ্ছেন ভবিষ্যতে সরকারি সুযোগ সুবিধা পাওয়ার আশায়।

এমন পরিস্থিতি সাঁওতাল শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান করতে সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি গড়ে তোলেন শ্যামল-মঙ্গল-রমেশ স্মৃতি বিদ্যা নিকেতন ও ফুলমনি সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র।

বিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড, ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

এই প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল ফুলমনি সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র। এখানে আদিবাসীদের মাতৃভাষা এবং তাদের সংস্কৃতি চর্চা করা হতো। ২০১৬ সালে সাঁওতাল পল্লী উচ্ছেদের সময় এই প্রতিষ্ঠানটিও পুড়িয়ে দেয়া হয়।

এর আগে সাঁওতাল শিশুরা বাগদা ফার্ম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতো। পরে তারা সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রের নাম পরিবর্তন করে পুলিশের গুলিতে নিহত তিনজনের নামে চালু করা হয় শ্যামল-মঙ্গল-রমেশ স্মৃতি বিদ্যা নিকেতন ও ফুলমনি সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র। এখানেই দেড় শতাধিক সাঁওতাল শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান করা হয়। কিন্তু তেমন কোন আসবাবপত্র নেই, টিনের একটি ঘরে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম।

শিক্ষক রয়েছেন মাত্র চারজন। বিনা বেতনে কর্মরত এই চারজন শিক্ষক স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে যাচ্ছেন ভবিষ্যতে সরকারি সুযোগ সুবিধা পাওয়ার আশায়।

শ্যামল-মঙ্গল-রমেশ স্মৃতি বিদ্যা নিকেতনের বাঙালি শিক্ষিকা বদরুন্নাহার বৃষ্টি বলেন, নিরাপত্তার শঙ্কায় এসব শিশুরা বাইরের স্কুলে যেতে চায় না। এসব শিশুরা যাতে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয় সেজন্য স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কিন্তু তাদের শিক্ষার জন্য কোন সরকারি সাহায্য সহযোগিতা নেই। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা থেকে মাঝেমধ্যে কিছু সহযোগিতা পাওয়া যায়। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছেন

 

তিনি বলেন, এসব শিশুদের পরিবারে খাদ্যের চরম অভাব, সেখানে পড়াশোনার খরচ বহন করাটা খুবই কষ্টসাধ্য। সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেলে খুব ভালো হতো।

অভিভাবক অলিভিয়া হেমব্রম বলেন, সন্তানদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে শিক্ষিত করতে চাই। কিন্তু দারিদ্রতা আর প্রতিকূলতার কারণে সন্তানদেরকে লেখাপড়া করানো যাচ্ছে না।

গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা অফিসার হামিদুল ইসলাম বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, আমি এই উপজেলায় নতুন এসেছি। সাঁওতাল পল্লীর শিশুদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আমার জানা নেই। আমি সেখানে যাবো এবং শিশুগুলো যেন পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

আদিবাসীদের শিক্ষা, জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করছেন বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর নজরুল ইসলাম। তিনি বার্তা টোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, সামগ্রিক আদিবাসীদের শিক্ষা ব্যবস্থা খুবই নাজুক। বাঙালিরা বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারলেও আদিবাসীদের যে মাতৃভাষা, সেই চর্চা তারা করতে পারছে না। ভাষার আগ্রাসনে ধীরে ধীরে তাদের নিজ ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। একটা সময় এই ভাষাটাও হারিয়ে যাবে। এটা শুধু ওদের ক্ষতি নয়। ক্ষতিটা আমাদেরও। কারণ এতে করে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালে ৬ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ সাঁওতাল পল্লীর আড়াই হাজার পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়। সেই সময় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় আদিবাসীদের ঘর-বাড়ি, গবাদিপশু এমনকি শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও। এসময় পুলিশের গুলিতে তিনজন নিহত হন, আহত হন ৩০ জন।

এরপর তারা পার্শ্ববর্তী জয়পুর ও মাদারপুর গ্রামে অন্যের জায়গায় আশ্রয় নেয় সাঁওতালরা। কিন্তু, গ্রামবাসী এখন আর ওই গ্রামে তাদের আশ্রয় দিতে চাচ্ছেন না। ফলে সাঁওতালরা আবারো ফিরছেন তাদের আদি নিবাস কুয়ামারা দিঘির পাড়ে। তৈরি করছেন ঝুপড়ি ঘর। তবে এখনও কাটেনি সেই ভয়াবহ হামলার আতঙ্ক। দু:স্বপ্নের মতো আঘাত হানে দুর্বিষহ সেই স্মৃতি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর