শাশুড়ির সঙ্গে জামাতার বিয়ে নিয়ে তোলপাড় হওয়া ঘটনার পরই বাড়ি ছাড়া শাশুড়ি ও জামাতা। ঘটনার শিকার মেয়েটিকে পাওয়া গেল না নিজ বাড়িতে। ঘটনার পর মেয়েও রয়েছে অন্যের বাড়িতে। শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) সরেজমিনে এমন চিত্র দেখা গেছে।
এলাকাবাসীর দাবি, ঘটনায় প্রভাবশালী মহল জড়িত থাকায় কথা বলতে নারাজ অনেকেই। এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনায় বিব্রতবোধ করছেন তারাও। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান কাদের তালুকদারসহ গ্রাম্য মাতব্বররা অবৈধ সালিশ বৈঠক করে জোর পূর্বক মেয়ের জামাতার সঙ্গে শাশুড়ির বিয়ে দেয়। তার আগে শাশুড়ি ও জামাতার অনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে মর্মে অভিযোগ তুলে সালিশে মারধরও করা হয় তাদের। তবে ভুক্তভোগী দুইপক্ষই হতদরিদ্র হওয়ায় এবং প্রভাবশালীরা বিচার করায় কেউ কোনো প্রতিবাদ করতে সাহস পায়নি। তবে সালিশে শাশুড়ি ও জামাতাকে নির্যাতনের সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়েছে।
তবে টাঙ্গাইলের কওমি ওলামা পরিষদের সহ-সভাপতি মুফতি মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম বলেন, আইন অনুযায়ী ৯০ দিন অতিবাহিত না হলে কোনোভাবেই তালাক বা বিয়ে কার্যকর হয় না। তাই ধর্মীয় বিচারে এ বিয়ে অনাচার। যারা এটা লঙ্ঘন করেছে তারা ধর্মকে অবমাননা করেছে বলে দাবি করেন তিনি।
টাঙ্গাইল কোর্টের সরকারি কৌশুলি বলেন, শাশুড়ি আর জামাতার সঙ্গে বিয়ে নিয়ে যা করা হয়েছে তা চরমভাবে দণ্ডনীয় অপরাধ।
জানা গেছে, টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার হাদিরা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকার গ্রাম কড়িয়াটা। এ গ্রামের নিতান্তই দরিদ্র নরু মিয়ার মেয়ে নূরন্নাহারের সঙ্গে চলতি বছরের আগস্টের ৯ তারিখে এক লাখ টাকার দেন মোহরে বিয়ে দেয়া হয় আরেক হতদরিদ্র পার্শ্ববর্তী ধনবাড়ি উপজেলার হাজরাবাড়ীর পূর্বপাড়া গ্রামের মৃত ওয়াহেদ আলীর ছেলে মোনছের আলীর। বিয়ের কিছুদিন সংসার জীবন ভাল কাটলেও কয়েকদিন পরই দেখা দেয় দাম্পত্য কলহ। বিয়ের মাত্র দেড় মাসের মাথায় (চলতি মাসে) মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে যান শাশুড়ি। চলতি মাসের ৮ অক্টোবর সকালে স্ত্রী, শাশুড়িকে সঙ্গে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি কড়িয়াটাতে আসেন মোনছের। এ সময় স্ত্রী নূরন্নাহার তার অভিভাবকদের স্বামীর সংসার আর করবেন না বলে জানায়।
আর তা নিয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্যসহ গ্রামবাসী সালিশ বৈঠক করেন। পরে বৈঠকে স্বামীর সঙ্গে সংসার করতে অস্বীকার করলে রাগ ও ক্ষোভে মেয়ের মা বলে উঠেন, তুই না করলে আমি করবো। আর এতেই মেয়ের জামাইয়ের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগ তুলে শাশুড়ি ও মেয়ের জামাইকে বেদম প্রহার করার আদেশ দেন বৈঠকে উপস্থিত চেয়ারম্যান, মেম্বার ও স্থানীয় মাতব্বররা। এরপর শ্বশুরকে দিয়ে জোরপূর্বক তার স্ত্রীকে (মেয়ের মা) তালাক দিতে বাধ্য করেন সালিশে উপস্থিত চেয়ারম্যান, মেম্বার ও স্থানীয় মাতব্বররা। পরে একই বৈঠকে কাজী ডেকে জোরপূর্বক শাশুড়ির সঙ্গে মেয়ের জামাইয়ের বিবাহ রেজিস্ট্রি করানো হয়।
সালিশ বৈঠকে বিয়ে পড়ানো কাজী গোলাম মওলা জিন্না বলেন, সালিশে ইউপি চেয়ারম্যান ও উপস্থিত লোকজন শাশুড়ির সঙ্গে জামাতার বিয়ে পড়ানোর জন্য বললে আমি শাশুড়ি আর জামাতার বিয়ে সম্পন্ন করে বিবাহ রেজিস্ট্রি করি। তবে এ ধরনের বিয়ে হয়না বললেও তারা মানেননি। পরে বাধ্য হয়েই বিয়ে পড়ানোর কাজ শেষ করি।
নুরুন্নাহারের মা বলেন, ব্যাপক মারধর করে জামাতার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক আছে এমন কথা স্বীকার করতে বাধ্য করা হয়েছে। স্বামীকে তালাক দিতেও বাধ্য করা হয়। পরে কাজী ডেকে জামাতার সঙ্গে আমার বিয়ে দেয়া হয়েছে। এ বিষয় নিয়ে আদালতে মামলা করবো।
মোনছের আলীর মা জানান, ঘটনার পর থেকেই সমালোচনা ও লোক লজ্জার ভয়ে এলাকা ছাড়া রয়েছেন মোনছের ও তার শাশুড়ি। তাদের মারপিট করে বিয়ে পড়ানোর ঘটনায় জড়িতদের বিচার চান তিনি।
মোনছের আলীর স্ত্রী নুরুন্নাহার জানান, বিয়ের পর স্বামী (মোনছের) শারীরিকভাবে নির্যাতন করতেন। সে কারণে তার বাবা মায়ের কাছে স্বামীর সঙ্গে সংসার করবে না বলে জানিয়ে দেন। কিন্তু এটা নিয়ে পরে গ্রাম্য সালিশ হয়। তারপরই এমন ঘটনা ঘটে। তবে মায়ের সঙ্গে তার স্বামীর সম্পর্ক নিয়ে তিনি কিছু বলেননি।
হাদিরা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নজরুল ইসলাম বলেন, সালিশে এমন পরিস্থিতি হয়েছিল তাতে বিয়ে ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না। বৈঠকে হাজারও লোকজন সমাবেত হয়েছিল। চেয়ারম্যানের নির্দেশে শাশুড়ি ও জামাতার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে।
টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শফিকুল ইসলাম জানান, বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে ঘটনা জানতে পেরেছি। তবে আইনের বাধ্যবাধকতা এবং কোনো পক্ষের অভিযোগ না থাকায় আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যায়নি।