লালন আখড়া (ছেঁউড়িয়া) কুষ্টিয়া থেকে: অসাধুদের ভিড়ে প্রকৃত লালন সাধকরাই আজ হারিয়ে যাচ্ছে। লালনের মাজারে তার ভাবাদর্শকে চর্চা না করে উল্টো সাধনার পরিবেশ নষ্ট করছে তারা। সাধু শাস্ত্রে আছে, ‘নিজ স্বভাব না ছাড়িলে গুরু কালে হয় না, স্বভাবে।’ লালন সাঁইজির নাম ব্যবহার করে যারা এসব করে বেড়াচ্ছেন, তাদের একজনেরও গুরু নেই। অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গেই কথাগুলো বলছিলেন বাউল সাধক ফকির হৃদয় শাহ।
শুক্রবার (১৮ অক্টোবরে) লালনের মাজারের মিলনায়তনে এই সাধকের সঙ্গে বার্তাটোযেন্টিফোর.কম-এর কথা হয়। লালন চর্চা ও মানুষ হওয়ার উপায়সহ বেশকিছু বিষয় নিয়ে কথা বলেন তিনি।
হৃদয় শাহ বলেন, ‘এদের (মাজারে যারা লালনের ভাবাদর্শ চর্চা করে না) কারও গুরুভাব নেই, এদের ভক্তির অভাব নেই। এরা গান গেয়ে বেড়াচ্ছে, নাচানাচি করে বেড়াচ্ছে, সাঁইজিদের পাশে বসছে, সাঁইজিদের পোশাক পড়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কয়জন লালন শাহকে অনুসরণ করছে?’
তিনি আরও বলেন, ‘লোকে বলে, ভাব না থাকলে ভক্তিতে কী হয়/ ভেবে বুঝে দেখ মনরায়, যার ভাব সেই জানতে পায়। আসলে আমাদের মূল্যবোধ এমন একটা অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, আমরা আধুনিক হয়েছি বটে, কিন্তু টোটালি আমরা যান্ত্রিক। আমাদের সাইকোলজি, ফিলোসফি এমন এক জায়গায় গিয়ে ঠেকছে- সেটা হলো ডাক্তারখানা।’
এই বাউল সাধক বলেন, ‘প্রকৃতি নির্ভর সাধনা করে বাউলরা, প্রকৃতির সঙ্গে বসবাস করে ফকিররা। আমি একটা উটকো মানুষ শহরবাসী ধুম করে এসে ফকিরের পাশে বসব, বুঝবোটা কী? বুঝতে হলে তৃষ্ণা থাকতে হবে। তৃষ্ণা থাকতে হলে সর্বপ্রথম আমাকে বিনয়ী হতে হবে। অথচ আমরা কোনো কিছুর মধ্যেই নেই। তাই আমরা সাঁইজির ভাষাও বুঝি না। আমরা যাই বুঝি যাই করি, সেটার আবার মূল্যায়ন চাই। লালন গবেষক হতে হবে। কিন্তু একটা ফকির তার কোনো কিছুর মূল্যায়ন চায় না। কে তারে ফকির ডাকল, সেটা তার দরকার নেই। দরকার হলো নিজের বোধকে, অনুভূতিকে জাগ্রত করা। আর এ জাগ্রত হওয়ার দুটো উপায়। একটা হচ্ছে আগ্রহ, আরেকটা বোধ। আমাদের আগ্রহ বেড়েছে কিন্তু বোধসত্ত্বা বাড়েনি।’
লালন মেলায় দর্শনার্থীদের আগ্রহ বৃদ্ধির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এতটা আমরা চাইনি। ধরে নিলাম, লালন চাইছে তাই হচ্ছে। কিন্তু লালন তো কাঁদেও যে, আমারে মানুষ বোঝে না ক্যান?’
উপস্থিত অসাধুদের (ঢোল ও হারমোনিয়ামে গান করছিলেন) দিকে দেখিয়ে হৃদয় শাহ বলেন, ‘এখানে সবাই গায়ক, সাধকটা কই? আপনি লালন মেলা করবেন মাঠে যান। কিন্তু ফকিরের মধ্যে এসে ফকির হওয়ার চেষ্টা করছেন কেন?’
লালন সংগীত বলে কিছু নেই জানিয়ে বাউল হৃদয় শাহ বলেন, ‘সংগীত হলো রবীন্দ্র সংগীত। আপনি দেখে পড়বেন। লালন তো দেখে পড়ার জন্য না। এটা ভাব গীতি। সাঁইজি তার ভক্তের উদ্দেশে বলেছেন, তিন পোড়াতেও খাঁটি হইলি না। তার ভক্তরা সে কথা বুঝলো না। সবই হলো সাঁইজির সত্যবাণী। তিনি তার ভক্তকুলের জন্য রেখে গেছে।’
ফকিরদের অতীত অবস্থানের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘আজ থেকে আড়াইশ বছর আগেও ফকিরদের দেখতে আসতো। দূর থেকে দেখতো। আড়াইশ বছর পরে এসে ফকিরের পাশে বসে দেখছে। কোনো সমস্যাতো নেই। তাহলে লালন সাঁই কেন বলল, চিনাল পেলে চিনে নিতাম, যেত মনের ধুকধুকি। তাহলে কী আমি চিনালটা খুঁজব না? তাহলে কী আমরা বিশুদ্ধ লালন চর্চার মধ্যে নেই?’
এ বাউল সাধক বলেন, ‘লালন সাঁইজি বললেন, ফকির লালন মরল জল পিপাসায়/ কাছে থাকতে নদী দেখনা। আর আমাদের শিল্পীরা গান গাচ্ছে, ফকির লালন মরলেন জল পিপাসায়/ কাছে থাকতে নদী মেঘনা। মেঘনা যমুনা কিছুই তো নাই আছে নদী কালীগঙ্গা। কী ধারণ করলাম আর কী পরিবেশন করলাম! চাতক পাখি মেঘের জল ছাড়া খায় না। তাই যে বছর অনাবৃষ্টি হয়, সে বছর বহু চাতক পাখিকে জলাধারের পাশে মরে পড়ে থাকতে দেখা যায়। সাঁইজি সেই কনসেপ্টটা বোঝাতে চেয়েছিলেন। আর আমরা গান গাচ্ছি কী? ফকির লালন মরলেন জল পিপাসায়/ কাছে থাকতে নদী মেঘনা।’
হৃদয় শাহ বলেন, ‘আমাদের মোবাইল ছিল না মোবাইল আসছে, ল্যাপটপ ছিল না ল্যাপটপ আসছে, টাইমপাস করতে পারি না ফেসবুক আসছে। কিন্তু ভালোটা হব কবে? আমরা আস্তে আস্তে ভোঁতা হয়ে যাচ্ছি। মূল্যবোধের যে অবক্ষয়ে দাঁড়িয়েছি, লালন দর্শনের কোনো বিকল্প নেই। একমাত্র লালন দর্শনের মধ্য দিয়ে আমরা মূল্যবোধের অবক্ষয় থেকে রক্ষা পাব।’