ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হবে বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর)।
রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ ও উভয় পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গত ৩০ সেপ্টেম্বর রায়ের জন্য এ দিন ধার্য করেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ।
চলতি বছরের ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার কার্যালয়ে আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি যৌন হয়রানির শিকার হন। এ ঘটনায় তার মা শিরীন আক্তার বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করেন। ওই দিনই স্থানীয়দের সহযোগিতায় পুলিশ অধ্যক্ষ সিরাজকে গ্রেফতার করে জেল-হাজতে পাঠায়।
এ ঘটনায় অধ্যক্ষ সিরাজের পক্ষে-বিপক্ষে পাল্টাপাল্টি অবস্থান নেন শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী। অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা তুলে নিতে নুসরাতের পরিবারকে চাপ দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে ৬ এপ্রিল পরীক্ষার কক্ষ থেকে ডেকে মাদ্রাসার সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে কেরোসিন দিয়ে নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তার চিৎকারে মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীরা এগিয়ে এসে নুসরাতকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখান থেকে তাকে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ এপ্রিল নুসরাতের মৃত্যু হয়।
৮ এপ্রিল নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান ৮ জনের নাম উল্লেখ করে থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলাটি পরবর্তীতে পিবিআইতে হস্তান্তর করা হয়। এ মামলায় মোট ২১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক মো. শাহআলম এ ঘটনায় ১৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। তদন্তে সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় পিবিআই অন্য ৫ জনকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করলে আদালত তা অনুমোদন করেন।
গত ২৭ জুন মামলার বাদী ও প্রথম সাক্ষী নুসরাত রাফির বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এ মামলায় গ্রেফতারকৃত মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা, ছাত্রদল নেতা নূর উদ্দিন, মাদরাসা শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি শাহাদাত হোসেন শামীম, নুসরাতের সহপাঠি উম্মে সুলতানা পপি, কামরুন নাহার মনি, জাবেদ হোসেন, আবদুর রহিম শরীফ, হেফজ বিভাগের শিক্ষক হাফেজ আবদুল কাদের ও জোবায়ের আহমেদ, এমরান হোসেন মামুন, ইফতেখার হোসেন রানা ও মহিউদ্দিন শাকিল আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।
অপর ৪ জন হলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি রুহুল আমিন, সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, মাদরাসার প্রভাষক নুরুল আবছার, মোহাম্মদ শামীম।
মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী এম. শাহজাহান সাজু বলেন, মাত্র ৬১ কার্যদিবসে বহুল আলোচিত এ হত্যা মামলার নিষ্পত্তি হতে চলেছে। যা দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হাফেজ আহম্মদ বলেন, ৮৮ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য, মামলার আলামত উপস্থাপন ও আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে এ হত্যা মামলার প্রকৃত চিত্র আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। আসামিদের প্রত্যেকের সর্বোচ্চ সাজা হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
এদিকে হত্যা মামলার রায়কে কেন্দ্র করে নুসরাত জাহান রাফির পরিবারে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। বাবা ও ভাইয়েরা গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলছেন। মা শিরীন আক্তারও মেয়ের শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বুধবার বিকেলে পৌর শহরের উত্তর চরছান্দিয়ায় গেলে দেখা যায়, বাড়ি ঘিরে সুনসান নিরবতা। বাড়ির দরজায় যথারীতি পুলিশ পাহারা রয়েছে।
নুসরাতের মা শিরীন আক্তার বলেন, তিনি হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন। তবে গত কিছুদিন ধরে তারা আতঙ্কগ্রস্ত বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, এক সিরাজের (মাদ্রাসার অধ্যক্ষ) বিরুদ্ধে মামলা দেয়ায় আমার মেয়েকে তারা পুড়িয়ে মেরেছে। এখন তো ১৬ জন আসামি। সুতরাং আমরা কেমন চাপে আছি আপনারা বুঝে নিন।
তিনি আরও বলেন, এ ঘটনায় দোষীদের এমন শাস্তি দেওয়া হোক যাতে আর কোন রাফি যেন বর্বরতার শিকার না হয়। রায় কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত বাড়িতে পুলিশি নিরাপত্তা আরও বাড়ানোর জন্য দাবি জানান শিরীন আক্তার।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সোনাগাজী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মঈন উদ্দিন আহমেদ বলেন, আলোচিত এ হত্যা মামলার রায়কে কেন্দ্র করে নুসরাত জাহান রাফির বাড়িতে আরও নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদা সতর্ক রয়েছে।