খুলনা অঞ্চলে মোট ৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল রয়েছে। আর এই পাটকল গুলোতে প্রায় ২৫০ কোটি টাকার পাটপণ্য অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) ও পাট মন্ত্রণালয়ের গাফিলতি এবং দেশে ও বর্হিবিশ্বে পাটপণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে, সময়মতো বিক্রি করতে না পারায় আর্থিক সংকটে পড়ছে মিলগুলো। এতে করে শ্রমিকদের মজুরি দিতে পারছে না মিল কর্তৃপক্ষ। এছাড়া পাটের ভরা মৌসুমেও কাঁচা পাট কিনতে পারছে না। আর কাঁচা পাটের অভাবে মিলগুলোতে উৎপাদনও কমে গেছে। ফলে পাটকলগুলোর শ্রমিকদের ৯ সপ্তাহের মজুরি এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তিন মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। এ নিয়ে শ্রমিক-কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া দীর্ঘদিন গুদামে পড়ে থাকায় পাটজাত পণ্যের মানও নষ্ট হচ্ছে।
এ সমস্যা থেকে উত্তরণে তৈরিকৃত মজুদ পণ্য বিক্রিতে বিজেএমসিকে উদ্যোগী হওয়ার তাগিদ দিয়েছে পাটকল কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিক নেতারা।
বিজেএমসির খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, খুলনার ক্রিসেন্ট, প্লাটিনাম, খালিশপুর, দৌলতপুর, স্টার, ইস্টার্ণ, আলীম এবং যশোরের জে জে আই ও কার্পেটিং জুট মিলে ৮৮৩ টন হেসিয়ান, ২৫ হাজার ৪ টন স্যাকিং, ৪ হাজার ৩৪৭ টন সিবিসি ও ৬৬ টন ইয়ার্ন নামক চার ধরনের পাটজাত পণ্য বিক্রির অপেক্ষায় পড়ে আছে। উৎপাদিত এসব পণ্য বিক্রি না হওয়ায় চরম আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছে। আর এ কারণে ব্যবসায়ীদের বকেয়া টাকা মিলগুলো সময়মতো পরিশোধ করতে পারছে না।
২০১৯-২০ অর্থ বছরের প্রথম তিন মাসে মোট চাহিদার মাত্র ১০ ভাগ পাট কিনেছে পাটকল কর্তৃপক্ষ। ফলে বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়, কমেছে পণ্য উৎপাদন। পাটকলগুলোর ২১ হাজার শ্রমিকের মধ্যে কাজ জুটছে ১১ হাজার ২৫২ জনের। আর ৩ হাজার ১১৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে ১ হাজার ২৩৫ জনের ভাগ্যে কাজ জুটেছে।
প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিলস শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি শাহানা শারমিন বলেন, ‘বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) ও পাট মন্ত্রণালয়ের গাফিলতিতে নির্দিষ্ট সময়ে টাকা ছাড় না দেয়ায় কাঁচাপাট কেনা সম্ভব হচ্ছে না। আর কাঁচাপাট সংকটের কারণেই মিলগুলোতে অচলাবস্থা।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে কাঁচাপাটের মৌসুম চলছে। অথচ পাটক্রয়ে অর্থ বরাদ্দ নেই। ফলে এখন স্বল্পমূল্যে পাটক্রয় করতে পারছে না মিলগুলো। পরবর্তীতে বেশি মূল্য দিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পাটক্রয় করতে হবে। এতে পাটপণ্যের উৎপাদন ব্যয়ও যেমন বেড়ে যাবে, তেমনি লোকসানেও পড়বে মিলগুলো।’
রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ শ্রমিকলীগ খুলনা-যশোর অঞ্চলের আহ্বায়ক মো. মুরাদ হোসেন বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোতে কাঁচাপাট না থাকায় শ্রমিকরা মিলে এসেও কর্মহীন অবস্থায় থাকে। পণ্য বিক্রি না হওয়ায় শ্রমিকদের মজুরি দিতে পারছে না মিল কর্তৃপক্ষ। পাটপণ্য বিক্রির দিকে সরকারকে আরো গুরুত্বারোপ করতে হবে।’
বাংলাদেশ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক খলিলুর রহমান বার্তাটোয়েন্টিফোর. কম কে বলেন, ‘অর্থের অভাবে কাঁচাপাট কিনতে পারছেনা মিল কর্তৃপক্ষ। এ কারণে মিলগুলোর অর্ধেকের বেশি শ্রমিকের কাজ নেই। এখন পর্যন্ত শ্রমিকদের ৯ সপ্তাহের মজুরি বকেয়া পড়ে আছে। কর্মচারীদেরও ৩ মাসের বেতন বকেয়া। অর্থ ছাড় এবং কাচাঁপাট কিনতে না পারলে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করবে।’
এ বিষয়ে প্লাটিনাম জুট মিলের মহাব্যবস্থাপক গোলাম রাব্বানী বলেন,‘বর্তমানে পাটক্রয়ের জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। একই সঙ্গে প্রচুর পরিমাণ উৎপাদিত পণ্য মজুদ রয়েছে। দেশে ও বর্হিবিশ্বে বর্তমানে পাটপণ্যের চাহিদা কম। চাহিদা কমে যাওয়ায় বিক্রি হচ্ছে না। আর্থিক সংকটে চলছে মিল। ফলে কাঁচাপাট কিনতে পারছি না। মৌসুম শেষ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কাঁচাপাটের অভাবে মিলে দৈনিক উৎপাদন যেখানে ৫০ টন ছিলো, সেখানে ১৭ টনে নেমে এসেছে।’
বিজেএমসির আঞ্চলিক সমন্বয় কর্তকর্তা বনিজ উদ্দিন মিয়া জানান, ‘কিছু জটিলতার কারণে নির্দিষ্ট সময়ে অর্থ পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থের অভাবে প্রয়োজনীয় কাঁচা পাট কেনা সম্ভব হচ্ছে না।
ফলে উৎপাদিত পাট পণ্যের মজুদ বেড়ে গেছে। মজুদ পণ্য বিক্রি করতে পারলে মিলগুলোর সংকট কেটে যাবে। প্রয়োজনীয় পাটও ক্রয় করতে পারবে মিলগুলো। পাটের মোড়কীকরণ আইন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে স্থানীয় বাজারে পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে এ অঞ্চলের পাটকলগুলোতে শ্রমিকদের ৯ মাসের মজুরির ৩৬ কোটি টাকা ও কর্মচারীদের ৪ মাসের বেতন ৪ কোটি টাকার মতো বকেয়া আছে।’
মিল কর্তৃপক্ষ জানায়, ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে কাঁচামাল হিসেবে মিলগুলির পাট কেনার লক্ষ্যমাত্রা র্নিধারণ করা হয়েছে ৮ লাখ ৩১ হাজার ৮৯৩ কুইন্টাল। কিন্তু গত তিন মাসে কেনা হয়েছে মাত্র ১ লাখ ২০ হাজার কুইন্টাল।
বিজেএমসি কর্তৃপক্ষ বলছে,অর্থাভাবে চাহিদামত কাঁচাপাট ক্রয়ে সম্ভব হচ্ছে না। সম্ভব হচ্ছে না লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী উৎপাদনেরও। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি হলে অর্থ সংকট কাটবে।
উল্লেখ্য, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৩০ শতাংশ পাট কিনতে পেরেছিল খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো। এ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত মাত্র ১০ শতাংশ পাট কেনা হয়েছে।
অর্থসংকটের কারণে চলমান মৌসুমে কৃষকদের কাছ থেকে পাট সংগ্রহে ব্যর্থ হলে পরবর্তীতে পাট ক্রয়ে কমপক্ষে ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় বাড়তে পারে মিলগুলির। খুলনা যশোর অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ব ৯টি পাটকলে পাটক্রয়ে এখনই সরকারি সহায়তা প্রয়োজন, অন্যথায় এ বছর রাষ্ট্রায়াত্ত পাটকলে লোকসান আরও বাড়ার শঙ্কা মিল সংশ্লিষ্টদের। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পাটকেনার দেনা ছিল ২৬ কোটি ৪৬ লাখ টাকা, ২০১৯-২০ অর্থ বছরের শুরুতে তা দাঁড়িয়েছে ৬০ কোটি ৫৪ লাখ টাকায়।