অভাব-অনটনের সংসার, আছে ঋণের চাপও। তবু দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে সুখেই ছিলেন মহিন আহমেদ সোহেল ও নাজমা আক্তার দম্পতি। দুই ছেলে মেয়েকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। তাইতো তাদের সুখের কথা চিন্তা করে গ্রামের বাড়ি বানিয়াচং ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন চট্টগ্রামে।
সংসারে যতই অভাব-অনটন থাক-না কেন, কখনো ছেলে-মেয়েদের ইচ্ছা অপূর্ণ রাখেননি। কিন্তু কে জানত এত আদরের মেয়েকে এভাবে হারাতে হবে, ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে সাজানো সংসার।
মঙ্গলবার (১৩ নভেম্বর) রাত ৩টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা কেড়ে নেয় মহিন আহমেদ সোহেল ও নাজমা আক্তার দম্পতির দুই বছর দুই মাস বয়সী একমাত্র মেয়ে আদিবা আক্তার সোহাকে। এ ঘটনায় আহত হয়ে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন সোহেল ও নাজমা।
পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়- অভাবের তাড়নায় ছেলে-মেয়েকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জের বানিয়াচং ছেড়ে চট্টগ্রামে গার্মেন্টসে চাকরি করতেন সোহেল ও নাজমা। সেখানে একটি ভাড়া বাসায় পরিবারের সবাইকে নিয়ে বসবাস করতে। সঙ্গে থাকতেন নাজমার মা রেনু আক্তার (৪৫)। তাদের অনুপস্থিতিতে দুই সন্তানকে দেখাশোনা করতেন তিনি।
দুর্ঘটনার রাতে দেশের বাড়ি বানিয়াচং থেকে কর্মস্থল চট্টগ্রাম ফেরার পথে দুই ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী ও শাশুড়ি রেনু আক্তারকে নিয়ে রাত সাড়ে ১২টায় শায়েস্তাগঞ্জ থেকে ‘উদয়ন এক্সপ্রেস’ ট্রেনে ওঠেন সোহেল। রাত ৩টার দিকে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত হয় তাদের একমাত্র আদরের মেয়ে সোহা। এ ঘটনায় আহত হন সোহেল ও নাজমা। তবে তাদের ছেলে ও শাশুড়ির তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি।
সকালে সোহামণির মৃত্যুর খবর আসে বাড়িতে। সঙ্গে সঙ্গে শোকে স্তব্ধ হয়ে যায় চারপাশ। বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে। এরই মধ্যে গুরুত্বর আহত সোহেল ও নাজমাকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। সারাদিন সোহার মরদেহ পড়ে থাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে ফ্লোরে। এমন একটি ছবিও ভাইরাল হয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। যে ছবিটি নাড়া দেয় দেশবাসীর হৃদয়কে।
পরে ওই দিন বিকেলে বাড়ি থেকে লোকজন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সোহার মরদেহ বাড়িতে এনে দাফন করা হয়। নিয়তির নির্মম পরিহাস, এত আদরের মেয়েকে শেষবারের মতো দেখা হলো না মা-বাবার। তাদের অনুপস্থিতিতেই মাটি চাপা দেওয়া হলো সন্তানকে।
বুধবার (১৩ নভেম্বর) বিকেলে বানিয়াচং উপজেলার তাম্মলিটুলা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়- শোকে স্তব্ধ চারপাশ। শুনসান নীরবতা বিরাজ করছে সোহার বাড়িতে। বাড়িতে ছিলেন সোহার দাদি সামছুন্নাহার বেগম, ফুফু জাহানারা বেগমসহ কয়েকজন আত্মীয়। সোহার বিষয়ে তাদের কাছে জানতে চাইলেই হাওমাও করে কেঁদে উঠেন তাঁরা। তাদের কান্নায় চোখে পানি ধরে রাখতে পারেননি সেখানে উপস্থিত কেউই। এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয় সেখানে।
বুক ভরা আর্তনাদ নিয়ে শিশু সোহার দাদি সামছুন্নাহার বেগম বলেন- ‘আমার নাতনি যখনই বাড়িতে আসত আমার কত ভালো লাগত। সারাক্ষণ আমার সাথে থাকত। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলত। খাবার খাওয়ার পর আমাকে পানের বাটি এনে দিয়ে বলত ‘দাদি আমি তুমাকে পান বানিয়ে দেই?’
তিনি বলেন- ‘আজ আমার নাতনি এই পৃথিবীতে নেই ভাবতেই পারছি না। এই বলেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।’
সোহার ফুফু জাহানারা বেগম বলেন- ‘সোহামণি অনেক মিষ্টি মেয়ে ছিল। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলত বলে আমরা ইচ্ছে করেই তাকে শুধু শুধু কথা বলাতাম। কিন্তু এখন আর আমাদের সোহামণি কোনো কথা বলবে না।’
তিনি বলেন- ‘আমি আমার সোহামণির মৃত্যুর বিচার চাই। এছাড়া সোহামণির বাবা-মা খুব দরিদ্র। তারা ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। ভালো চিকিৎসা করার সামর্থ্য তাদের নেই। তাই আমি সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি তাদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য।’
এদিকে, বাড়ি থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরের একটি করবস্থানে চিরনিন্দ্রায় শায়িত করা হয়েছে সোহাকে। সেখানে গিয়ে দেখা যায় কবরের উপরে সবুজ কলাপাতা দিয়ে কবরটি ডেকে রাখা হয়েছে। এ সময় সেখানে উপস্থিত অনেকেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলছিল- ‘যে মেয়েটিকে এতো ভালোবাসতেন তারা, সেই মেয়েটিকে শেষ দেখার ভাগ্য হলো না তাদের।’