ন্যায্যমূল্যতো অনেক দূরের কথা সরকারের কাছে বিক্রির মাধ্যমে ধানের নূন্যতম দাম পেতে গুদাম পর্যন্ত পৌঁছানোই দুরূহ ছিল উত্তরের জেলা নাটোরের কৃষকদের জন্য। ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের এক শক্তিশালী সিন্ডিকেটের অদৃশ্যহাত নিয়ন্ত্রণ করতো ধানের বাজার। তাই চলতি আমন মৌসুমে জেলার কৃষকদের কাছে প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি ছিলো ধানের নায্যমূল্য নিশ্চিত করা।
ন্যায্যমূল্যের অন্তরায় মধ্যস্বত্বভোগীদের (দালাল) দৌরাত্ম বন্ধে জেলার কৃষকদের কাছ থেকে উন্মুক্ত লটারির মাধ্যমে আমন ধান ক্রয় করতে শুরু করেছে খাদ্য বিভাগ।
বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) নাটোর সদর উপজেলার বড় হরিশপুর ইউনিয়নের শংকরভাগ কলেজ মাঠে ধান ক্রয়ের জন্য কৃষকদের নির্বাচিত করতে উন্মুক্ত লটারি সম্পন্ন হয়।
জানা যায়, প্রতি মৌসুমে বাজারে ধানের দাম না থাকায় লাগাতার লোকসান দিয়ে আসছেন কৃষকরা। লোকসান পূরণ করার লক্ষ্যে কৃষকদের কাছ থেকে সরকারি মূল্যে ধান ক্রয় করার জন্য জেলা প্রশাসনের নির্দেশক্রমে লটারির মাধ্যমে নির্বাচন করা হচ্ছে কৃষকদের।
সদর উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় কৃষি ও খাদ্য বিভাগ আয়োজিত লটারির মাধ্যমে কৃষক নির্বাচন অনুষ্ঠানে নাটোর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মেহেদুল ইসলাম, সদর এলএসডি ইনচার্জ আবুল কালাম আজাদ, বড় হরিশপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ওসমান গণি ভুইয়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক সুব্রত কুমার সরকার জানান, চলতি মৌসুমে জেলায় ৫৯ হাজার ২৯০ হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হয়েছে।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক শফিকুল ইসলাম জানান, চলতি মৌসুমে জেলায় উৎপাদিত মোট আমন ধানের মধ্যে ৮ হাজার ৫৯৬ মেট্রিক টন ধান কিনবে সরকার। এ লক্ষে ৭টি উপজেলায় পৃথক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সদর এলএসডি ইনচার্জ আবুল কালাম আজাদ জানান, প্রতিকেজি ২৬ টাকা দরে সদর উপজেলার একটি পৌরসভা ও ৭টি ইউনিয়নের কৃষকদের কাছ থেকে মোট এক হাজার ৩২৮ মেট্রিক টন ধান ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার বড় হরিশপুর ইউনিয়নের কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ডধারী সাড়ে ছয় হাজার কৃষকের মধ্য থেকে উন্মুক্ত লটারীর মাধ্যমে ২২২ জন কৃষক নির্বাচন করা হয়েছে।
এদিকে, দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে কৃষকরা তাদের কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড প্রদর্শনের মাধ্যমে পরিচিতি নম্বর স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে জমা দিয়ে লটারীতে অংশগ্রহন করেন। উন্মুক্ত পদ্ধতির এই লটারি আয়োজনে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন কৃষকরা।
বড় হরিশপুর ইউনিয়নের জাঠিয়ান গ্রামের নাসিম উদ্দীন বলেন, গোলায় ধান তুললেই সিন্ডিকেটের লোকজন এসে উপকরণ সহায়তা কার্ড নিয়ে যেতেন। কৃষক হিসেবে আমার ধান বিক্রির নিশ্চয়তা থাকতো না। এখন আমরা আশ্বস্ত।
শংকরভাগের আমেনা বেগম বলেন, লটারির মাধ্যমে ধান বিক্রি শুরু হওয়ায় অন্তত এই আশাটুকু করছি যে, ভাগ্যে থাকলে নিজের ধান নিজেই বিক্রি করবো।
নারানগাছি গ্রামের করিম মন্ডল বলেন, এবার লটারির মাধ্যমে ধান বিক্রি সুযোগ নিয়েছি। বছরের পর বছর রাজনৈতিক নেতারা যোগসাজশ করে আমাদের হক নষ্ট করেছে। সরকার আগামীতে এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখলে কৃষক ক্ষতির হাত থেকে বাঁচবে।
পিরজিপাড়া গ্রামের আব্দুল কাদের বলেন, ধানের সিন্ডিকেট ভাঙ্গছে লটারির মাধ্যমে। কোনো নেতা কার্ড নিয়ে কৃষকের পরিবর্তে নিজের ধান বিক্রি করতে পারবে না। এতে কৃষকরা খুশি।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কৃষকদের আস্থা ফেরাতে ইউনিয়ন পর্যায়ে গিয়ে লটারির ব্যবস্থা করা হয়ছে। উন্মুক্ত লটারি পদ্ধতিতে কৃষকরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এতে প্রকৃত কৃষকরা ধানের ন্যায্যমূল্য পেয়ে উপকৃত হবেন।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শাহরিয়াজ বলেন, আমরা কৃষকদের ধানের নায্যমূল্য নিশ্চিত করতে চাই। তাই লটারির মাধ্যমে প্রশাসন কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে ধান কিনছে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অসাধু মধ্যস্বত্বভোগীদের মূল উৎপাটন করাও সম্ভব হবে। পর্যায়ক্রমে উপজেলার পৌরসভা ও অন্যান্য ইউনিয়নেও উন্মুক্ত লটারি সম্পন্ন করা হবে।