১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাস। দেশের বিভিন্ন জেলায় তখন পাকিস্তানি মিলেটারীরা আত্মসমর্পণ করছে। ধীরে ধীরে শত্রুমুক্ত হচ্ছে দেশ। কিন্তু তখনো ফরিদপুরে নির্যাতন, হামলা, লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছে হানাদার বাহিনী ও তার দোসররা।
১৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক বিজয় অর্জনের ১ দিন পরে ১৭ ডিসেম্বর দুপুরে ফরিদপুর সার্কিট হাউজে তারা আত্মসমর্পণ করে। সেদিন সকালেও পাক মিলিশিয়া ও বিহারীদের সঙ্গে মরণপণ যুদ্ধ করেছে ফরিদপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
ফরিদপুরের মুক্তিযোদ্ধা মো. শামসুদ্দিন মোল্যা ১৭ ডিসেম্বরের যুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, 'মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. মোকাররম হোসেন ও আবুল ফয়েজ শাহনেওয়াজ এবং মুজিব বাহিনীর থানা কমান্ডার নীতি ভুষন সাহার নেতৃত্বে ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা বর্তমান রাজবাড়ী জেলার সুলতানপুর ইউনিয়নের লক্ষনদিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবস্থান করছিলো। আমাদের ওপর দায়িত্ব ছিল মুক্তি ও মুজিব বাহিনীর যৌথ কমান্ডের নেতৃত্বে বিভিন্ন জায়গায় গেরিলা অপারেশন করার। দেশের অনেক জায়গা তখন শত্রুমুক্ত হলেও ফরিদপুর ছিল পাক হানাদারদের দখলে। যৌথ কমান্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফরিদপুর শহর আক্রমণ করার জন্য আবুল ফয়েজ শাহনেওয়াজের নেতৃত্বে ৩০/৪০ জনের একটি দল অম্বিকাপুর ইউনিয়নের ভাষানচরে অবস্থান নেয়। হাবিলদার আবু তাহের দেওয়ানের নেতৃত্বে ১৪ জনের অপর একটি দলে আমরা চরমাধবদিয়া ইউনিয়নের আব্দুল মোল্লার বাড়িতে অবস্থান নেই। আগের দিন ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও ফরিদপুরে থাকা হায়েনারা তখনো আত্মসমর্পণ করেনি।'
তিনি তার বর্ণনায় বলেন, '১৭ ডিসেম্বর সকাল ৮টায় আমার নাস্তা করছিলাম। এমন সময় ক্যাম্পে খবর এলো গোয়ালন্দ সশস্ত্র পাক বাহিনী পদ্মার পাড় দিয়ে ফরিদপুরের দিকে এগিয়ে আসছে। আমাদের কমান্ডরা আবু তাহের দেওয়ান দ্রুত পজিশন নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। আমরা পদ্মা থেকে উঠে আসা একটা নালার ভিতর এ্যামবুশ নিলাম। পাক মিলিশিয়া ও বিহারীদের দলটি সামনে চলে আসল, আমার গুলি চালালাম, ওরাও পাল্টা গুলি শুরু করে দিল। এরইমধ্যে আমাদের কমান্ডার পাশের ফয়েজ ভাইয়ের ক্যাম্পে ও খলিলপুরের যৌথ কমান্ডের ক্যাম্পে খবর পাঠিয়ে দেন। আমাদের কাছে অস্ত্র বলতে এলএমজি, এসএলআর, রাইফেল, স্টেনগান ও গ্রেনেড। ফায়ারিং এর এক পর্যায়ে আমরা বুঝতে পারি যে আমরা ওদের গুলির রেঞ্জের ভিতরে। তখন আমরা গুলি করতে করতে পিছু হটতে থাকি। এসময় আমাদের সহযোদ্ধা ইউনুস মোল্লার গুলি লাগে, কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পরেন। খবর পেয়ে যৌথ বাহিনী ক্যাম্প থেকে নিতিভুষন সাহা, খান মাহাবুবে খোদা, আবুল ফয়েজ শাহনেওয়াজ এবং মেজবাউদ্দীন খান মিরোজের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা এই যুদ্ধে অংশ নেয় শহীদ সালাউদ্দীন বাহিনীর ডা. ইমরান মজুমদার রুনু, আমিনুর রহমান ফরিদ, খলিলসহ ফরিদপুরের প্রায় সকল মুক্তিযোদ্ধারা খবর পেয়েই আমাদের সাহায্যের জন্য চলে আসে। অন্যদিকে খবর পেয়ে মানিকগঞ্জ থেকে ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিমের নেতৃত্বে লঞ্চে করে পদ্মা পার হয়ে বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা এই যুদ্ধে অংশ নিতে আসে।
ক্যাপ্টেন নূর মো. বাবুল তার টিম থেকে ২ ট্রাকে করে মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠায় এই যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য। বেলা ২ টার দিকে শেষ হয় এই যুদ্ধ। প্রায় শতাধিক মিলিশিয়া ও বিহারী মারা যায় বলে জানান তিনি। কথা বলার এক পর্যায়ে তিনি কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন যুদ্ধ শেষ, মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষত বিক্ষত চরাঞ্চল জুরে আনন্দে ফায়ারিং করছে। আর সেই সময় আমারা সহযোদ্ধা ইউনুস মোল্লার মরদেহ নিয়ে ৩৮ দাগ গ্রামে তার বাড়িতে যাই।
মুক্তিযোদ্ধা মো. সাখাওয়াত হোসেন বললেন, এই ১৭ ডিসেম্বরই মুক্তিযোদ্ধা শাহ মো. আবু জাফরের নেতৃত্বে ৩০/৩৫ জনের মুজিব বাহিনীর একটি টিম বিজয়ের খবর শুনে বোয়ালমারী থেকে ফরিদপুর আসার পথে মাঝকান্দি নামক জায়গায় পৌছলে কামারখালী থেকে আসা পাক আর্মির দুটি ট্রাকের সামনা সামনি হয়ে যায়। মুজিব বাহিনীর যোদ্ধারা কমান্ডারের নির্দেশে পজিশন নিয়ে ফায়ারিং শুরু করলে পাক আর্মির ট্রাক থেকে এক অফিসার হাত উঁচু করে নেমে এসে আত্মসমর্পণ করে। পরে মুজিব বাহিনীর যোদ্ধারা ওদের আটক করে ফরিদপুর সার্কিট হাউসে নিয়ে আসে।
আগরতলা মামলার ৫ নম্বর আসামী ও মুক্তিযুদ্ধকালীন সাব সেক্টর কমান্ডার নূর মোহাম্মদ ক্যাপ্টেন বাবুল পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের কথা বলতে গিয়ে জানান, 'হেমায়েত বাহিনীকে সাথে নিয়ে গোপালগঞ্জকে মুক্ত করে আমরা ফরিদপুর আক্রমণ করার লক্ষে ভাঙ্গায় এসে অবস্থান নেই। এরই মাঝে খরব আসে ঢাকাতে পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে, আমরা যুদ্ধে জয়ী হয়েছি। খবর পেয়ে আমি আমার দল নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই ফরিদপুরে ঢুকি।
তিন বলেন, ফরিদপুরে ঢুকেই আমি পাকিস্তান আর্মির কমান্ডার আরবান খানকে আত্মসমর্পণের জন্য বলি। আরবান খান আমার পাঠানো লোকের কাছে জানিয়ে দেয় সে মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে না তিনি মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। এরই প্রেক্ষিতে মিত্র বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার রাজেন্দ্র প্রসাদ নাথ ফরিদপুরে উপস্থিত হন। আরবান খান রাজেন্দ্র প্রসাদ নাথ ও আমার কাছে আত্মসমর্পণ করে। এভাবেই ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পরে বিজয়ের ১ দিন পরে এসে ফরিদপুর জেলা শত্রুমুক্ত হয়।