চুয়াডাঙ্গার চার উপজেলার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক কোনো স্কুলেই নেয়া হচ্ছে না শিক্ষার্থীদের মাল্টিমিডিয়া ক্লাস। সপ্তাহের একদিন স্কুলের প্রতিটি শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদের মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নেবার কথা থাকলেও তা নেয়া হয় না। এদিকে শিক্ষকদের মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নিতে বলা হলেও তারা তা নেন না বলে অভিযোগ করছে শিক্ষার্থীরা।
জেলার প্রায় ৮০ ভাগ স্কুলের শিক্ষার্থীরা মাল্টিমিডিয়া ক্লাস সম্পর্কে কিছুই জানে না। অন্যদিকে দীর্ঘদিন স্কুলগুলোতে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস না হওয়ায় প্রায় স্কুলে সরঞ্জামও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদের মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের আগ্রহ থাকলেও নানা সমস্যার কারণে আধুনিক এ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা। জেলার স্কুলগুলোতে নানা সমস্যা থাকলেও মাল্টিমিডিয়া ক্লাস যথারীতি হয় বলে দাবি জেলার শিক্ষা কর্মকর্তাদের।
জানা গেছে, ২০১০ সালে শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি নির্ভর ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে সরকার প্রায় ৩০৪ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের বিশ হাজার পাঁচশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের প্রতিটি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আধুনিক শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য ল্যাপটপ-কম্পিউটার ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর সরবরাহ করা হয়। তবে সরকারের এই পরিকল্পনার দশ বছর অতিবাহিত হয়ে গেলে মাঠ পর্যায়ে স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষে নেয়া হয় না মাল্টিমিডিয়া ক্লাস।
চুয়াডাঙ্গা জেলায় ৪৪৫টি প্রাথমিক ও ১৪১টি মাধ্যমিক স্কুল রয়েছে। জেলার ৩৫৮টি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক সবকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রয়েছে শিক্ষার্থীদের জন্য মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম। তবে এসব স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস চালু থাকলেও তা শুধুই নামে মাত্র। স্কুলগুলোতে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের জন্য সরঞ্জাম থাকলেও শিক্ষকরা তা ব্যবহার করেন না। জেলার বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ থাকে তালাবদ্ধ। এছাড়া অনেক স্কুলে দেখা যায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নিতে ল্যাপটপ ঠিকমতো ব্যবহারই করতে পারেন না শিক্ষকরা। এ ছাড়া গ্রামের বেশ কয়েকটি মাধ্যমিক স্কুলে গিয়ে দেখা যায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের জন্য সরকারের দেয়া ল্যাপটপ শিক্ষকরা ব্যবহার করছেন ব্যক্তিগত কাজে।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার শঙ্করচন্দ্র ইউনিয়নের ৫৫ নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানায়, মাল্টিমিডিয়া ক্লাস কি তা তারা জানে না। স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র রাতুল জানায়, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের কথা শুনলেও কোনদিন স্যার-ম্যাডামরা তা নেননি।
আলমডাঙ্গা উপজেলার ৭০নং খাসবাগুন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী লিমা খাতুন জানায়, মাল্টিমিডিয়া ক্লাস সম্পর্কে কিছু যানে না সে। ক্লাস নিতে বললেও শিক্ষকরা মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নেন না।
চুয়াডাঙ্গা শহরের সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী রিজিয়া খাতুন জানায়, স্কুলে মাল্টিমিডিয়া সকল সরঞ্জাম থাকার পরও শিক্ষকরা নিয়মিত মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নেন না। এতে করে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। আমরা চাই শ্রেণিকক্ষে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নিয়মিত হোক।
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নিতে নিজেদের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে শিক্ষকরা বলছেন, সরকারিভাবে অল্প দিনের আইসিটিতে যে টেনিং মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের জন্য তাদের দেয়া হয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। ফলে স্কুলে মাল্টিমিডিয়ার সরঞ্জাম থাকলেও শিক্ষকদের অদক্ষতা, স্কুলের অবকাঠামো ও শিক্ষক সঙ্কটের কারণেই স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের মাল্টিমিডিয়া ক্লাস বন্ধ রয়েছে।
বোহালগাছী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আজিম উদ্দিন জানান, শিক্ষার্থীদের মাল্টিমিডিয়া ক্লাস মাঝে-মধ্যে নেয়া হয় তার স্কুলে। তবে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নিতে ভিডিও কন্টেন্ট ডাউনলোড করে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেয়া খুবই কষ্টকর ব্যাপার। যার কারণে সহকারী শিক্ষকরা শ্রেণীকক্ষে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নিতে আগ্রহী হন না।
খাসবাগুন্দা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইয়াকুব আলী জানান, মাল্টিমিডিয়া ক্লাস সম্পর্কে প্রশিক্ষিত যে শিক্ষক রয়েছেন, তিনি নিজেই অদক্ষ। তাছাড়া মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নিতে আইসিটি যে ট্রেনিং সরকার শিক্ষকদের দিয়েছে তাতে কোন লাভ হয়নি। এ কারণে শ্রেণিকক্ষে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের শিক্ষক জানান, শিক্ষক সঙ্কটের কারণে স্কুলে নিয়মিত মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নেয়া সম্ভব হয় না। জেলার স্বনামধন্য সরকারি স্কুল হলেও এখানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে একদিন মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নেয়ার।
প্রাথমিক স্কুলগুলোতে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের দুর্দশার কথা স্বীকার করে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বার্তা২৪.কম-কে জানান, জেলার অনেক প্রাথমিক স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নেয়ার সরঞ্জাম নষ্ট হওয়ায় ক্লাস কার্যক্রম বন্ধ হয়ে আছে। তারপরও যেসব স্কুলে সরঞ্জাম থাকার পরও শিক্ষার্থীদের মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নিচ্ছে না, সেসব স্কুলের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অন্যদিকে জেলা শিক্ষা অফিসার নিখিল রঞ্জন চক্রবর্ত্তী বলছেন চুয়াডাঙ্গায় মাধ্যমিক সব স্কুলেই নেয়া হয় শিক্ষার্থীদের মাল্টিমিডিয়া ক্লাস। অ্যাপসের মাধ্যমে জেলার প্রতিটি স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নিয়মিত শিক্ষার্থীদের নেয়া হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করে শিক্ষা অফিস।
তবে সকল বাধা পেরিয়ে স্কুলের শ্রেণিকক্ষে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস করতে আগ্রহী শিক্ষার্থীরা। শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছে তাদের দাবি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের জন্য যাতে সবরকম ব্যবস্থা করা হয়।