গাজীপুর হাজতখানায় জমজমাট পুলিশের ‘সাক্ষাৎ বাণিজ্য’

গাজীপুর, দেশের খবর

মাহমুদুল হাসান,ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট,বার্তা২৪.কম,গাজীপুর | 2023-08-26 18:25:57

ঢাকার মিরপুর থেকে গাজীপুর আদালতের হাজতখানায় ছোট ভাই জীবনকে দেখতে এসেছেন আবু সাঈদ। জীবনকে চুরির মামলায় গ্রেফতারের পর কারাগারে পাঠাতে হাজতখানায় এনেছে পুলিশ।

নিজের ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে হাজতখানা থেকে আবু সাঈদ বের হওয়ার পর সোমবার (২০ জানুয়ারি) দুপুর দেড়টার দিকে তার সঙ্গে কথা বলে বার্তা২৪.কম।

তিনি জানান, হাজতখানায় ঢুকতে প্রথম গেইটে ঘুষ দিয়েছেন ২০০ টাকা। ভেতরের আরেকটি গেইটে দিয়েছেন আরও ২০০ টাকা। এ ছাড়া মোবাইল জমা রাখতে ৫০ টাকা ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছেন।

সিরাজগঞ্জের কাজীপুর এলাকা থেকে গাজীপুর হাজতখানায় ছেলে আবু হাশেমকে (১৮) দেখতে এসেছেন মধ্যবয়সী আজিবর। হাজতখানা থেকে সোমবার (২০ জানুয়ারি) দুপুর পৌনে দুইটার দিকে তিনি বের হয়ে বার্তা২৪.কম-কে জানান, তার ছেলে গাজীপুরের হোতাপাড়া এলাকার একটি পোশাক কারখানায় কাজ করত। একটি বিস্ফোরক মামলায় জয়দেবপুর থানার পুলিশ তার ছেলেকে গ্রেফতার করেছে। একদিন আগে তিনি বাসে করে সিরাজগঞ্জ থেকে গাজীপুরে এসেছেন। রাতে কোনাবাড়ীতে এক আত্মীয়ের বাসায় থেকেছেন। রোববার (১৯ জানুয়ারি) গাজীপুর জেলা কারাগারে অনেক চেষ্টা করেও তিনি ছেলের সাক্ষাৎ পাননি।

আসামিদের সাক্ষাৎ পেতে স্বজনদের ভিড়/ ছবি: বার্তা২৪.কম 

এরপর সোমবার (২০ জানুয়ারি) তিনি গাজীপুর হাজতখানায় এসে ছেলের সঙ্গে দেখা করেছেন। তবে এর জন্য পুলিশ তার কাছ থেকে খরচ বাবদ ৪০০ টাকা ঘুষ নিয়েছে।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, গরীব মানুষ। অনেক দূর থেকে ছেলের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। সঙ্গে প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা নেই। তার মধ্যে এতগুলো টাকা ঘুষ দিতে হলো। অনেক কাকুতি-মিনতি করে পুলিশকে বলেছিলাম কিছু টাকা কম নিতে। কিন্তু পুলিশ বলেছে এক পয়সা কম দিলেও সাক্ষাৎ করা যাবে না।

আজিবরের সঙ্গে একই এলাকা থেকে ছোট ভাই মোহাম্মদকে (১৮) হাজতখানায় দেখতে এসেছেন তরুণী রমিজা বেগম। তিনি জানান, আজিবরের ছেলে আবু হাশেমের সঙ্গে একই কারখানায় কাজ করত তার ভাই। তারা দুজন একই কক্ষে থাকত। হঠাৎই মাস তিনেক আগে পুলিশ দুজনকে ধরে থানায় নিয়ে যায়। পরে জানতে পারি দুজনই বিষ্ফোরক মামলার আসামি। তিনিও কারাগারে গিয়ে ভাইয়ের সাক্ষাৎ পাননি। এরপর হাজতখানায় এসে ৪০০ টাকা ঘুষ দিয়ে ছোট ভাইকে একনজর দেখেছেন।

বার্তা২৪.কমের দীর্ঘ অনুসন্ধানে দর্শনার্থীদের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। হাজতখানা থেকে বের হয়ে আসা ২০ জনের বেশি হাজতির স্বজনের সঙ্গে কথা হলে- প্রত্যেকে প্রায় একই রকম বক্তব্য দিয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গাজীপুর জেলা ও মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) আলাদা হাজতখানা নেই। থানা থেকে আসামিদের কারাগারে না পাঠানো পর্যন্ত এবং কারাগার থেকে মামলায় হাজিরা দিতে আসামিদের হাজাতখানায় রাখা হয়। একটি বদ্ধ কক্ষের মেঝেতে আসামিদের দীর্ঘ সময় কাটাতে হয়। কক্ষটির উত্তর-পূর্ব কোনায় রয়েছে প্রস্রাব-পায়খানার খোলা টয়লেট। এই দুর্গন্ধ বাধ্য হয়েই বন্দিদের সহ্য করতে হয়। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই খেতে হয় স্বজনদের দেওয়া খাবার।

আসামিদের সাক্ষাৎ পেতে স্বজনদের ভিড়/ ছবি: বার্তা২৪.কম 

আদালত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, হাজতখানাকে ‘ঘুষখানা’য় পরিণত করেছেন দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা। যতরকম অনিয়ম- সব সেখানে নিয়মে পরিণত হয়েছে। হাজতখানার ভেতরে দর্শনার্থীদের ঢুকতে প্রথম ফটকে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ কনস্টেবলদের হাতে দিতে হয় জনপ্রতি ন্যূনতম ২০০ টাকা। টাকা নেওয়ার পর ওই কনস্টেবল ‘সিগন্যাল’ দিলেই কেবল ভেতরে যেতে দেওয়া হয়। এরপর সেখানে নেওয়া হয় আরও ২০০ টাকা। আর দর্শনার্থীদের সঙ্গে থাকা মোবাইল জমা রাখার নামে নেওয়া হয় ২০-৫০ টাকা। হাজতখানার বারান্দায় রাখতে প্রতি আসামির স্বজনদের কাছ থেকে নেওয়া হয় ৫০০-২০০০ টাকা। হাজতখানার ইনচার্জের কক্ষে বসে সাক্ষাৎ করতে দিতে হয় ৩-৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। জামিনের জন্য ওকালত নামায় আসামির সই নিতে দিতে হয় ১২০ টাকা। আসামির স্বজনদের আনা খাবার হাজতখানার ভেতরের আসামির কাছে দিতেও গুনতে হয় অতিরিক্ত টাকা। হাজতখানার ভেতরে-বাইরে নজরদারির জন্য ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা থাকলেও ঘুষ বাণিজ্যে মাতোয়ারা পুলিশ সদস্যরা।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের তথ্যমতে, কারাগার থেকে মামলায় হাজিরা দিতে আসা বন্দিরা এখানে জড়াচ্ছে নানা অপরাধে। কিছু পুলিশ সদস্যকে লোভে ফেলে মাদকসহ অনৈতিক সুবিধা নিচ্ছে অপরাধীরা। তারা পুলিশ সদস্যদের ম্যানেজ করে মোবাইল ব্যবহারের পাশাপাশি সহযোগীদের সঙ্গে দেখা করারও সুযোগ পাচ্ছে। এমনকি বেশি টাকা ঘুষ দিয়ে হাজতখানার ইনচার্জের কক্ষে বসেও বাইরের অপরাধীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছে ‘ভিআইপি’ আসামিরা। সেখানে বন্দিদের খাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরাই।

গাজীপুর কোর্ট হাজত/ ছবি: বার্তা২৪.কম

সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রতিদিন প্রায় কয়েক’শ মানুষ তাদের স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে হাজতখানায় আসেন। যাদের প্রত্যেককেই ঘুষ দিতে হয়। শুধুমাত্র উকিল ও সাংবাদিকরা ঘুষ ছাড়া ভেতরে ঢুকতে পারেন।

গাজীপুর জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে হাজতখানার ইনচার্জের দায়িত্বে আছেন রাশিদা বেগম। তিনি ছাড়াও চারজন এটিএসআই এখানে দায়িত্ব পালন করেন। যাদের একজন ট্রেনিংয়ে রয়েছেন। এছাড়াও কতজন ফোর্স রয়েছে সেটি জানাতে পারেননি রাশিদা বেগম। প্রতিদিন জেলা পুলিশের ৫টি থানা, কয়েকটি ফাঁড়ি ও কারাগার থেকে শতাধিক আসামি এই হাজতখানায় আনা হয়।

দর্শনার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়টি জানেন না দাবি করে রাশিদা বেগম বলেন, আমি বা আমরা টোটালি কোনও টাকা-পয়সা নিই না। দর্শনার্থীরা মিথ্যা বলছে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, দর্শনার্থীরা মিথ্যা কথা বলছে কিনা সেটিও জানি না। হাজতে খোঁজ খবর নিয়ে বিষয়টি দেখবেন জানিয়ে তিনি বলেন, আপনার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চাই।

হাজতখানায় গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) ইনচার্জ এসআই আব্দুল আলী। তিনিসহ মোট নয়জন পুলিশ সদস্য সেখানে কর্মরত রয়েছেন। প্রতিদিন গড়ে মেট্রোপলিটন পুলিশের আটটি থানা ও কারাগার থেকে ১ শ’র বেশি আসামি এই হাজতখানায় আনা হয়।

আসামিদের প্রিজন ভ্যানে উঠানো হচ্ছে/ ছবি: বার্তা২৪.কম

দর্শনার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার প্রসঙ্গে গাজীপুর জেলা আদালতের পরিদর্শক রকিবুল হক বার্তা২৪.কম-কে বলেন, টাকা নেওয়ার বিষয়ে কোনও দর্শনার্থী বা আইনজীবী আমার কাছে অভিযোগ দেয়নি। অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য জানালে তিনি বলেন, আসেন... সাক্ষাতে কথা বলি।

জানতে চাইলে জিএমপির প্রসিকিউশন শাখার দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার (এসি) এ কে এম আহসান হাবীব বার্তা২৪.কম-কে বলেন, হাজতখানা নিয়ন্ত্রণ করে জেলা পুলিশ। আমরা জাস্ট সরকারের পক্ষে হাজতখানায় আসামি রাখি। কিন্তু হাজতখানার কোনও নিয়ন্ত্রণ মেট্রোর নাই।

সাক্ষাৎ বাণিজ্যের বিষয়ে তিনি বলেন, আমার অর্থাৎ মেট্রোর লোকজন যারা সেখানে দায়িত্বে আছে তাদের দর্শনার্থীদের কাছ থেকে টাকা নিতে নিষেধ করা আছে। এই অভিযোগে আগে কয়েকজনকে বদলিও করা হয়েছে। তারপরও যদি সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দেখাতে পারেন আমি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।

এ সম্পর্কিত আরও খবর