দেশি ও আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্র চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তকে সোনা পাচারের নতুন রুট হিসেবে ব্যবহার শুরু করেছে। অরক্ষিত সীমান্ত ও বিট খাটাল থাকার সুযোগে চাঁপাইনবাবগঞ্জকেই নিরাপদ রুট হিসেবে টার্গেট করেছে সোনা চোরাচালানিরা।
সম্প্রতি ৫৩ বিজিবি’র সদস্যরা বাখের আলী সীমান্ত থেকে ২০টি সোনার বারসহ এক পাচারকারীকে আটক করে। এ ঘটনায় সদর মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করে বিজিবি। মামলাটি তদন্ত করছেন সদর মডেল থানার এসআই নাজমুল হক। তবে অজ্ঞাত কারণে গণমাধ্যমে এ তথ্য দেয়নি বিজিবি। আটক সোনা পাচারকারী রবু চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়নের গোঠাপাড়ার আবদুল মান্নানের ছেলে।
গত বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) দুপুরে সোনামসজিদ জিরো পয়েন্টে ৩টি স্বর্ণের বারসহ মোহাম্মদ আলী নামে একজনকে আটক করেছে সোনামসজিদ কাষ্টমস শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ। জুতার মধ্যে লুকিয়ে বারগুলো ভারতে পাচারের সময় আটক করা হয় তাকে। আটক মোহাম্মদ আলী ফেনী জেলার রামপুর গ্রামের মো. গোলাম মোস্তফার ছেলে ।
সোনামসজিদ কাষ্টমস গোয়েন্দা বিভাগের সুপার মো. শাহজাজাহান আলী জানান, বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টার দিকে সোনামসজিদ জিরো পয়েন্টে ৫৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের তল্লাশি চৌকিতে মোহাম্মদ আলীর ব্যাগ তল্লাশি করা হয়। পরে তার পায়ের মোজার মধ্যে লুকানো সোনার বার বের করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি ভারতের মালদা শহরে স্বর্ণগুলো পাচারের উদ্দেশ্যে সোনামসজিদ ইমিগ্রেশন দিয়ে পার হচ্ছিলেন বলে জানিয়েছেন।
শাহজাজাহান আলী আরও জানান, প্রতিটি বারের ওজন একশো গ্রাম করে, যার আনুমানিক মূল্য ১৫ লাখ টাকা। এ ব্যাপারে শিবগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলকে ঘিরে সোনা পাচারকারীদের একটি শক্তিশালী চক্র রয়েছে। প্রশাসনের নজর এড়িয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ভারতে সোনা পাচার করছে চোরাকারবারিরা। হুন্ডির কারবারে প্রশাসনের নজরদারির কারণে ভারতে সোনা পাচার হচ্ছে। সোনা বিক্রির টাকা দিয়ে মাদক অস্ত্রসহ বিভিন্ন চোরাচালান পণ্য বাংলাদেশে নিয়ে আসছে তারা। সোনা পাচারকারী চক্রটি দুই দেশেই অত্যন্ত শক্তিশালী। তাই মূল মালিক থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ও গরুর রাখালদের মাধ্যমে সীমান্ত পথে সোনা পাচার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পাচারকারীদের কেউ কেউ আটক হলেও পর্দার আড়ালে থেকে যাচ্ছে প্রকৃত চোরাকারবারিরা।
চোরাকারবারিরা বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) চোখ এড়িয়ে দীর্ঘদিন ধরেই এই অবৈধ কারবার চালিয়ে আসছে। গোপন সংবাদ ছাড়া কোনো অবস্থাতেই সোনার চালান আটক করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের আশেপাশে সীমান্তগুলো ভারতের সঙ্গে ৫৭ কিলোমিটার বিস্তৃত। কাঁটাতারের বেড়া না থাকায় চোরাকারবারিরা চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্ত পথকে সোনা পাচার ও মাদকসহ চোরাচালান পণ্যের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। দেশে মাংসের চাহিদা পূরণ ও রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১৪ সালে বিট খাটাল নীতিমালা জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। নীতিমালা জারির পর সীমান্ত বিট খাটাল গড়ে ওঠে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে চালু রয়েছে ৯টি বিট খাটাল। এই বিট খাটালে গরু-মহিষ আমদানির সুযোগ নিয়ে চোরাকারবারিরা ভারতীয় বিভিন্ন পণ্যের সঙ্গে হরহামেশাই দেশে মাদক ও আগ্নেয়াস্ত্রের চালান ঢোকাচ্ছে। আর এসব আগ্নেয়াস্ত্র হাতবদল হয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার অপরাধ চক্রের সদস্যদের হাতে ছড়িয়ে পড়ছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
বিদায়ী বছরে রেকর্ড পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধার করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পুলিশ সুপার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মাদকের ১৪১৮টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে ২ হাজার ৬৩ মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবী। উদ্ধার করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য।
সূত্র জানায়, ২০১৯ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ২৪ কেজি ৯২২ গ্রাম ৯৪ পুরিয়া হোরোইন উদ্ধার করা হয়েছে। ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে ২ লাখ ৩৯ হাজার ৬৪০ পিস। ৬৫ হাজার ৫২১ বোতল ফেনসিডিল। এছাড়াও গাঁজা উদ্ধার করা হয়েছে ২২৭ কেজি ৯১১ গ্রাম। ১৪৫৯ অ্যাম্পল নেশাজাতীয় ইনজেকশন, বিদেশি মদ উদ্ধার করা হয়েছে ৪৪ বোতল ১৫ লিটার। একই সময়ে ৪ হাজার ৬৩৯ লিটার দেশীয় মদ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ৫৩টি বিদেশি পিস্তল, দেশি পিস্তল ১টি, শুটারগান ১৪টি, ৮৯টি ম্যাগজিন ও ২৭৪ রাউণ্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে।
৫৩ বিজিবি’র অধিনায়ক লে. কর্নেল মাহমুদুল হাসান জানান, সব ধরনের তথ্য আমরা গুরুত্ব সহকারে দেখে থাকি। মাদক চোরাচালান প্রতিরোধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি নতুন করে সীমান্ত এলাকা থেকে ২৩টি সোনার বারসহ দুই পাচারকারীকে আটক করা হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত সোনা পাচারের স্থায়ী রুট হিসেবে পরিণত হওয়ার আগেই চোরাকারবারিদের ধরতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলে জানান তিনি।