গেল বছরের ২৭ নভেম্বর মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের ভানুগাছ সড়কের পাশ থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে নিজেদের জায়গা উদ্ধার করেছিল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। অভিযানে রেলের প্রায় ২ দশমিক ৮৭ একর জায়গা উদ্ধার করা হয়। কিন্তু উচ্ছেদ অভিযান শেষ হবার কিছুদিনের মধ্যেই আবারো শতকোটি টাকা মূল্যের এই জমি দখল শুরু হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, আগের অভিযানে উচ্ছেদ হওয়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিকরা তাদের দোকানের সাইনবোর্ড লাগিয়ে বাঁশ, কাঠ, টিন ব্যবহার করে দোকানঘর তৈরি করছেন। ফার্নিচারের দোকানগুলোতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে মালামাল। খালি জায়গাগুলো আবারো গড়ে তোলা হচ্ছে নতুন সব দোকান।
হাতিল ফার্নিচারের লোকমান হোসেনের ছেলে দেলোয়ার হোসেন শাওন বলেন, আমরা এখানে ৩৫ বছর ধরে ব্যবসা করছি। নোটিশ না দিয়ে রেলওয়ে আমাদের এখান থেকে উচ্ছেদ করে। উচ্ছেদের দিন মাল সরানোর সময়টুকু পর্যন্ত দেয়া হয়নি। শুধু মাত্র মাইকিং করা হয়েছে। কোন জায়গা উচ্ছেদ করা হবে সেটি উল্লেখ করা হয়নি। বর্তমানে আমরা এই জমিতে এতদিন ধরে দখলে আছি। যদি রেল লিজ দেয় তাহলে আমাদেরকে দিতে হবে।
আনোয়ারা ট্রেডার্স, খান ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড ওয়ার্কস, হোসেন ট্রেডার্স অ্যান্ড মটরসসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক বলেছেন, সবাই তো আগের দখলকৃত জায়গায় নিজেদের ঘর তুলছে। কেউ বাধা দিচ্ছে না। তাই আমাদের পুরোনো দোকানের জায়গায় নতুন করে ঘর তুলছি। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ উচ্ছেদ করতে চাইলে সে সময় উঠে যাব। কিন্তু এখন যদি দখল করে না রাখি পরে এই জায়গা আরেকজন দখল করে নেবে।
আনাস ফার্নিচারের মালিক আবুল খায়ের বলেন, দুই বছর আগে ৮ লাখ টাকা দিয়ে এখানে জমি কিনেছিলাম। এখন অস্থায়ীভাবে আছি। রেলওয়ের জায়গা যদি লিজ দেয়, তাহলে আমরা নেব। এই আশায় বসে আছি।
মেসার্স মির্জা ট্রেডার্সের স্বত্তাধিকারী মির্জা কামাল হোসেন বলেন, শওকত মিয়া নামে সেন্ট্রাল রোডের এক পেঁয়াজের আড়তদার ব্যবসায়ির কাছ থেকে দুই বছর আগে ১৬ লাখ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম। এর পর জমিতে মাটিভরাট করা, পাকা ঘর বানানোসহ ৩৩ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। এখন আমরা ছাউনি দিয়ে ইট ফেলে জায়গা দখল করে রেখেছি। আমাদের ইচ্ছা হলো, সরকার যদি লিজ দেন, তাহলে আমরা লিজ নেয়ার দাবীদার।
তিনি বলেন, কয়েক দিন আগে রেলের সার্ভেয়ার এসে যারা যারা সাইনবোর্ড দিয়ে দোকানপাট বসিয়েছেন তাদের তালিকা করে নেন। ওই সময় জিআরপি থানার ওসি বলেছিলেন নতুন দখলদারদের নামে নাকি মামলা হয়েছে। কই এর পরে তো আর কেউ আসেনি।
এদিকে গত ১৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ রেলওয়ের কুলাউড়া সেকশনের ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী (কার্য) মো. জুয়েল হোসাইন বাদী হয়ে অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য শ্রীমঙ্গল জিআরপি থানায় একটি লিখিত এজহার দাখিল করেছেন। এতে মোট ১৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়।
এরা হলেন- মো. আলী পিতা-মাসুক মিয়া, আব্দুল হাই পিতা আব্দুল মান্নান, নোয়াব মিয়া পিতা-অজ্ঞাত, মো. খালিছ খান পিতা মৃত তোতি খান, মিলন মিয়া পিতা অজ্ঞাত, মো.লোকমান হোসেন পিতা মৃত হাজী সিকান্দার, মো. শাহ আলম পিতা মো. সিরাজ খান, আব্দুল মোমিত পিতা অজ্ঞাত,
আব্দুল মোমিন পিতা মৃত আসলাম মিয়া, মো. আবুল খায়ের পিতা মৃত আব্দুল জনি, মো. ইমরান হোসেন পিতা মৃত মো. হোসেন মিয়া, মো. রিপন পিতা মৃত আলী, মো. শাহজাহান মিয়া পিতা অজ্ঞাত, মো. হাফিজ মিয়া পিতা অজ্ঞাত।
জানতে চাইলে শ্রীমঙ্গল জিআরপি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেন বলেন, সরকারি রেলওয়ের জায়গা উচ্ছেদ করার পর আবার তারা অনধিকার প্রবেশ করে ঘর দরজা নির্মাণ করার চেষ্টা করছে এমন অভিযোগে লিখিত এজহার দাখিল করেছে। আমরা বিষয়টি ইনভেস্টিগেশন করেছি। এর সত্যতাও পেয়েছি। রেলের জমি যে দখল করেছে, সেটি আমরা ভিডিও করে রেখেছি। কিন্তু দখলকৃত এই জমির অবস্থান রেলওয়ের সীমানায় না হওয়ায় এর কার্যক্রম নিবে বেঙ্গল থানা।
ওসি বলেন, আমি বাদী মো. জুয়েল হোসাইনকে টেলিফোনে বলে দিয়েছি আমার কাছে যে এজহারটা দিয়েছিলেন সেটা ঠিক আছে। এটি রেলওয়ের জায়গা। কিন্তু এই জমি আমার জুরিসডিকশনের মধ্যে পরে নাই। এটা বেঙ্গল থানার জুরিসডিকশন। আরেকটা এজহার লিখে বেঙ্গল থানার ওসিকে দিতে বললে তিনি বলেছেন বেঙ্গল থানায় এজহার দিবেন।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম জানান, রেলওয়ের জায়গা দখলমুক্ত করার কাজটা রেলপথ মন্ত্রণালয়ের। তারা যখন উচ্ছেদ অভিযান করে তখন তিনি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এখন আবারও নতুন করে ওই জমি বেদখল হচ্ছে। এ বিষয়টি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের নজরে আনা হবে। তারা আবারও উচ্ছেদ অভিযান করতে চাইলে তাদেরকে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হবে।
এ বিষয়ে রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘ ৩৮ বছর পর আমরা মহামূল্যবান ওই জায়গাটি অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে উদ্ধার করেছিলাম। এখনও কাউকে ওই জায়গা লিজ (ইজারা) দেওয়া হয়নি। শুনেছি আবারও দখলের চেষ্টা চলছে। আমি আমিনের (সার্ভেয়ার) কাছে ব্যাখা চেয়েছি কীভাবে এই জায়গা আবার দখল হচ্ছে। তাকে বলা হয়েছে দখলদারদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা দায়ের করার জন্য।