দারিদ্র্যের চরম কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সাভারে পাড়ি জমিয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। জীবিকা ও জীবনের তাগিদে তারা পোশাক শিল্পসহ বিভিন্ন কারখানায় কাজ করছেন। সারাদিন শ্রম দিতে গিয়ে এদের মধ্যে অনেকেই ভুলে যায় নিজেকে। তারা হারিয়ে যায় নিজের কর্মের মাঝে। হারিয়ে যায় নিজের জন্ম তারিখটাও।
তবে ভিন্ন উদ্যোগে পোশাক শ্রমিকসহ বিদেশি ক্রেতাদের মন কেড়েছে সাভারের আশুলিয়ার শিমুলতলায় অবস্থিত স্যামস এ্যাটায়ার লিমিটেড নামের একটি পোশাক কারখানা। যেখানে কর্মরত আছে প্রায় ১ হাজার ৮'শ শ্রমিক। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাস থেকে কারখানাটির উপ-মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন ও মানব সম্পদ) তারিকুল ইসলামের উদ্যোগে ১ হাজার ৮'শ শ্রমিকের জন্মদিন উদযাপিত করে আসছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। প্রতিদিন ওই কারখানায় কারো না কারো জন্মদিন উদযাপিত হচ্ছে টানা দুই বছর ধরে। এতে প্রতিদিনই উৎসবের আমেজ বিরাজ করে কারখানাটির মাঝে। এই পোশাক কারখানায় উৎসবের আমেজে মাতোয়ারা হয়ে শ্রমিকরা কাজ করে আপন মনে। এতে করে যেমন আকৃষ্ট হচ্ছেন শ্রমিকরা তেমনি সাধুবাদ জানিয়েছেন বিভিন্ন দেশের ক্রেতারা।
ওই কারখানার পোশাক শ্রমিক মোছা: সারজিনা আক্তারের (সুইং অপারেটর) সঙ্গে কথা হলে তিনি বার্তা২৪.কম-কে বলেন, আমি কখনও ভাবিনি আমার জন্মদিন উদযাপিত হবে। সাধ্য না থাকায় জন্মদিন উদযাপনের স্বাদ জাগেনি কোনোদিনই। কাজের চাপে ভুলেই গিয়েছিলাম আমার জন্ম তারিখ। কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, আমার বাবা-মাও কোনোদিন জন্মদিন উদযাপনের স্বাদ দিতে পারতো না। কিন্তু এই কারখানা কর্তৃপক্ষ আমাকে এই স্বাদ পাইয়ে দিয়েছে। আমি কোনোদিন এই কারখানার কথা ভুলবো না। যতদিন কাজ করার সামর্থ্য ও বেঁচে থাকবো ততদিনই এই কারখানায় কাজ করে যাবো।
অপর শ্রমিক মো: সেলিম (সুইং অপারেটর) বার্তা২৪.কম-কে বলেন, আমরা সাধারণ শ্রমিক। আমাদের জন্য এরকম একটি উদ্যোগ নেবে কারখানা কর্তৃপক্ষ তা ভাবতেই পারি নি। কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের জন্মদিন পালন করার পাশাপাশি গিফট প্রদান করে থাকে। অন্যান্য শ্রমিকরাও বিভিন্ন ধরনের গিফট নিয়ে আসে জন্মদিনের উপহার দেওয়ার জন্য। সব মিলিয়ে মনে হয় এক পরিবারের অটুট বন্ধন। তিনি বলেন, কারখানায় প্রবেশ করতেই মনটা ভরে ওঠে। কারখানা কর্তৃপক্ষ যেভাবে আমাদের মূল্যায়ন করে আমরাও চেষ্টা করি তার যথাযথ প্রতিদান দিতে। শুধু জন্মদিন পালনই না, এখানে ঈদের ছুটির পর যারা প্রথম অফিসে আসে তাদের মধ্যে লটারি করে পুরস্কার প্রদান করা হয়। মোট কথা এই কারখানায় কাজ করতে পেরে আমরা ভাগ্যবান মনে করি।
কারখানাটির অপারেশন ম্যানেজার চঞ্চল মজুমদার বার্তা২৪.কম-কে বলেন, আমরা শ্রমিকদের অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য সব সময়ই ব্যতিক্রম কিছু ভাবি। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে আমরা শ্রমিকদের জন্মদিন পালন করার সিদ্ধান্ত নেই। এখানে প্রতিদিনই কোনো না কোনো শ্রমিকের জন্মদিন পালন করা হয়। আমাদের কর্তৃপক্ষরা শ্রমিকদের এন্ট্রি করা ডাটা থেকে জন্মদিনের তথ্য সংগ্রহ করে শ্রমিককে আগের দিন বলে দেন তার জন্মদিনের কথা। তাকে আরও বলা হয় আগামীকাল যা আছে তার মধ্যে ভালো পোশাকটি পড়ে আসতে। জন্মদিন উপলক্ষে আগে থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করে কারখানা কর্তৃপক্ষ। কাজের স্থানে শ্রমিকদের মাথার ওপর ঝুলানো থাকে বেলুন। আর ঝুলানো বেলুন দেখেই সবাই বুঝতে পারে কার কার জন্মদিন। গত ১ জানুয়ারি এক সঙ্গে ৩৭৮ জনের জন্মদিন পালন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
কারখানার উৎপাদন কর্মকর্তা সুফী আহমেদ রাজীব বার্তা২৪.কম-কে বলেন, শ্রমিকদের জন্মদিন পালনের পর থেকে তুলনামূলক উৎপাদন বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেতন পাওয়ার পর অনেক শ্রমিক কারখানা পরিবর্তন করে অন্য কারখানায় কাজ নিতো। এখন তুলনামূলক এই কারখানা ছেড়ে যাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা অনেক কম। সবাই উচ্ছ্বসিত হয়ে মনোযোগের সঙ্গে কাজ করে চলেছে।
এব্যাপারে বাংলাদেশ বস্ত্র ও পোশাক শিল্প শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সারোয়ার হোসেন বার্তা২৪.কম-কে বলেন, পোশাক শিল্পে এ ধরনের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। এ ধরনের উদ্যোগে পোশাক শিল্পের গতিশীলতা বাড়ে। এভাবে শ্রমিকদের জন্মদিন পালন করলে শ্রমিকরা উৎসাহী হয়ে কাজে আরো মনোযোগী হবে। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। আমাদের শিল্পের উন্নয়ন হবে।