‘জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনাইড’—বিচার কাজ বিলম্বিত হলে ন্যায়বিচার ব্যাহত হয়। মামলাজটের কারণে গাজীপুর আদালতে নিত্যদিন বিচারকাজ ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বিচারপ্রত্যাশীরা।
মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য অতিরিক্ত আদালত ও বিচারক বাড়ানো এবং শূন্য পদে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
বার্তা২৪.কমের অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য বলছে, দুর্নীতি, রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব, আইনজীবীদের ইচ্ছাকৃত সময়ক্ষেপণ, বিচারক পরিবর্তন, সময়মতো সাক্ষী হাজির না হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে মামলাজট সৃষ্টি হচ্ছে।
গাজীপুর জেলা ও দায়রা জজের অধীনে ১২টি আদালত রয়েছে। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসির অধীনে রয়েছে ৯টি আদালত। এর মধ্যে জুডিশিয়াল চারের ম্যাজিস্ট্রেট মাতৃত্বকালীন ছুটিতে রয়েছেন।
আদালতের বার্ষিক বিবরণী বলছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গাজীপুরের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসি আদালতে মোট মামলার সংখ্যা ৪৭ হাজার ৭৯৭টি। এর মধ্যে ২৯ হাজার ৬০১টি মামলা জেনারেল ফাইলের (জিআর) আওতাভুক্ত। বাকি ১৮ হাজার ১৯৬টি মামলা বিচার ফাইলে (ট্রায়াল) রয়েছে। এই সময়ে ম্যাজিস্ট্রেসির সব আদালতে মামলা দায়ের হয়েছে ২০ হাজার ৬৬৭টি। এই বিভাগে গত এক বছরে ৩৩৬টি মামলার সাজা হয়েছে। আর খালাসপ্রাপ্ত মামলার সংখ্যা ১ হাজার ১৪৭টি। গত বছর ১৬ হাজার ৪৬৪টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। সাক্ষী উপস্থিত হয়েছেন ৫ হাজার ৮১৪ জন। আর ২০১৯ সালে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ২৯ হাজার ৮৫০টি।
নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারির শেষে মোট মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩১ হাজার ৬৯৫টিতে। এই সময়ে মোট মামলা কমেছে ১৬ হাজার ১০২টি। নতুন করে মামলা দায়ের হয়েছে ১ হাজার ৮৪৫টি। সাজা হয়েছে ৪৩টি মামলায়। খালাসপ্রাপ্ত মামলার সংখ্যা ১০৬টি। চলতি বছরের জানুয়ারিতে নিষ্পত্তি হয়েছে ২ হাজার ৩১৯টি মামলা। ফেব্রুয়ারি মাসে এসে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ২২৭টিতে। যেখানে গত বছরের ডিসেম্বরে মামলার সংখ্যা ছিল ২৯ হাজার ৮৫০টি। কমেছে ৬২৩টি মামলা। এই সময়ে ৬৯৭ জন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। বর্তমানে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসির অধীনে জনবল রয়েছে ৬২ জন।
এ ছাড়াও গাজীপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিচারাধীন মামলা রয়েছে ৪ হাজার ৭১০টি। এর মধ্যে নারী সংশ্লিষ্ট মামলার সংখ্যা ৪ হাজার ১০৫টি, শিশু সংশ্লিষ্ট ৫৭৯টি ও মানবপাচার মামলা রয়েছে ২৬টি।
তবে ১৫ দিনের বেশি চেষ্টা করেও গাজীপুরের জেলা ও দায়রা জজের অধীনস্ত ১২টি আদালতের মামলা সংক্রান্ত কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আওলাদ হোসেন তথ্য প্রদানে বার্তা২৪.কমের কাছে অপারগতা প্রকাশ করেন।
মামলা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। মামলাজট নিরসনে হিমশিম খেতে হচ্ছে বিচারকদের। মামলার অনুপাতে নতুন বিচারক ও সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ হচ্ছে না। নির্দিষ্ট সময়ে আদালত বসছে না। দিনের পর দিন শুনানি হয় না অনেক মামলার। সর্বোপরি মামলার ব্যয়, ধীর গতি, নগরায়নসহ নানা কারণে মামলার সংখ্যা বেড়ে জট সৃষ্টি হচ্ছে।
বিচারপ্রার্থীরা মনে করেন, দ্রুততম সময় ও সুলভে মামলা-মকদ্দমা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হলে জট কিছুটা কমবে। সেই সঙ্গে বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা বাড়বে।
সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) আদালত প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা যায়, শত শত বিচারপ্রার্থী আদালতে ভিড় করছেন। মামলাজটের কারণে অনেকে পরবর্তী তারিখ জেনে বাড়ি ফিরছেন। বিচারকরাও চাপ সামলাতে না পেরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে সবার হাজিরা মঞ্জুর করে দিচ্ছেন।
গাজীপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মনজুর মোর্শেদ প্রিন্স বার্তা২৪.কমকে বলেন, গাজীপুরে জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় মামলা ও বিচারপ্রার্থীর সংখ্যাও বেশি। বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহত্তর বার গাজীপুর। আইনজীবী সমিতিতে সদস্য রয়েছে ১ হাজার ৯৫০ জন। আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য যে পরিমাণ ভবন দরকার এখানে সেটি নেই। এখানে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজস্ট্রেটের কার্যালয় নেই। ভাওয়াল রাজবাড়ীতে যেসব জনাকীর্ণ ভবন রয়েছে সেখানে ম্যাজিস্ট্রেসি আদালতের কার্যক্রম চলছে।
তিনি বলেন, মাঝে মধ্যে বিচারকের পদ শূন্য থাকে। নারী ও শিশু কোর্ট একটি। মহানগর হওয়ার পর নতুন আটটি থানা হয়েছে। কিন্তু আদালতের সংখ্যা বাড়েনি।
মহানগরের জন্য আলাদা আদালত গঠনের অগ্রগতি সম্পর্কে অ্যাডভোকেট মনজুর মোর্শেদ বলেন, আদালতের পাশেই কোয়ার্টারের মাঠে নতুন ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সিএমএম আদালত প্রতিষ্ঠা হলেই মামলাগুলো বণ্টন হয়ে যাবে। তখনই মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। বর্তমানেও মামলা নিষ্পত্তির হারও আশানুরূপ।
বেসরকারি সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার বার্তা২৪.কমকে বলেন, প্রথমত আদালতের সংখ্যা অপর্যাপ্ত তার ওপর অতিরিক্ত মামলার চাপ। দেওয়ানি হোক বা ফৌজদারি—দিনের পর দিন মামলাগুলো পড়ে থাকে। বিশেষ করে ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে তদন্ত প্রতিবেদন (চার্জশিট) দিতে অনেক গড়িমসি হয়। এর বড় উদাহরণ সাংবাদিক দম্পত্তি সাগর-রুনি হত্যা মামলা।
তিনি বলেন, মামলা নিষ্পত্তিতে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিতে হবে। এটি নেই বলে বিভিন্ন পক্ষের কারসাজিতে বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে। ফলে দিনের পর দিন মামলার চাপ বাড়ছেই। দেখা যায় দুপুরের পর পরই আদালতের কার্যক্রম শেষ হয়ে যায়। পুরো অফিস টাইম যদি আদালত চলতো তাহলে অনেকটা চাপ কমতো।