বায়ান্নর ফেব্রুয়ারি, সারাদেশে ভাষা আন্দোলন তুঙ্গে। ভাষা আন্দোলনের ঢেউ লেগেছিল নাটোরেও। সে সময়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে নাটোরে সক্রিয়ভাবে যারা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন তাদের মধ্যে ভাষা সৈনিক ফজলুল হক অন্যতম।
তখন তিনি নাটোরের জিন্না মেমোরিয়াল স্কুলের (বর্তমানে নাটোর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়) নবম শ্রেণির ছাত্র। ঝাঁপিয়ে পড়েন ভাষার অধিকার আদায়ের আন্দোলনে। তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে নিজের ও পার্শ্ববর্তী স্কুলের শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করেন তিনি। আর এজন্য তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়। এরপর দীর্ঘদিন পালিয়ে বেড়াতে হয় তাকে।
ফজলুক হক জানান, ৫২’র ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্র-জনতা। পাক-সরকার সেদিন রাজপথে মিছিলরত ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালালে সালাম, জব্বার, রফিক, শফিক, বরকতসহ বেশ কয়েকজন শহীদ হন। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি এ খবর নাটোরে পৌঁছালে ছাত্র-জনতা মাতৃভাষা রক্ষার দাবিতে নেমে পড়েন রাজপথে। এদিন নাটোরের জিন্না মেমোরিয়াল স্কুলের (বর্তমানে সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়) নবম শ্রেণির ছাত্র ক্লাস ক্যাপ্টেন ফজলুল হক ভাষার জন্য তার স্কুলের সকল ছাত্রকে সংগঠিত করেন।
এরপর সবাই মিলে শহরের বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে যান। সেখান থেকে ওই স্কুলের শিক্ষকদের অনুমতিক্রমে ছাত্রীদের নিয়ে চলে যান মহারাজা জে এন উচ্চ বিদ্যালয়ে। পরে তিনটি স্কুলের সব শিক্ষার্থী মিলে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এই স্লোগান দিয়ে ফজলুল হকের নেতৃত্বে শহরে মিছিল ও সমাবেশ করেন। এ অপরাধে হুলিয়া মাথায় নিয়ে দিনের পর দিন পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে তাকে।
সেদিনের মিছিল-মিটিংয়ে অগ্রগামী ফজলুল হক স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। তার প্রত্যাশা, অনেক ত্যাগ আর প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাভাষার সঠিক চর্চা অব্যাহত থাকবে। শহীদদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনারের সঠিক মর্যাদা দেওয়া হবে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার থাকবে।
ফজলুল হক বলেন, আমি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাইনি বলে ক্ষোভ নেই। মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনে নিজে শরিক হতে পেরেছিলাম এবং অন্যদের সংগঠিত করতে পেরেছিলাম বলে আমি গর্ব বোধ করি। তবে কষ্ট লাগে, এতো রক্ত আর আন্দোলনের অর্জন বাংলা ভাষার বিকৃত ব্যবহার, অপপ্রয়োগ দেখে। এই বাংলা ভাষায় আরো বেশি সাহিত্য চর্চা হওয়া খুবই দরকার।
১৯৩৮ সালে সিংড়া উপজেলার দমদমা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তিন মেয়ে ও এক ছেলের জনক ফজলুল হক বর্তমানে নাটোরের কান্দিভিটা এলাকায় বসবাস করেন।
মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় সাহসী ভূমিকা রাখা মানুষটি ভাষা আন্দোলনের ৬৮ বছর পরও পাননি কোন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। ২০১০ সালে নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শতবর্ষ পূর্তিতে বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয় ভাষাসৈনিক ফজলুল হককে। এই মহান ভাষা সৈনিক তার জীবদ্দশায় রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পাবেন এমনটি প্রত্যাশা তার পরিবার আর নাটোরবাসীর।
জেলা প্রশাসক মো. শাহরিয়াজ বলেন, প্রতি বছর একুশে বইমেলায় ভাষা সৈনিক ফজলুল হককে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আগামীতেও তাকে যথাযোগ্য সম্মান দিতে চেষ্টা করা হবে।