হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যে প্রকাশ্যে চলছে গাছ পাচারের মহোৎসব। মাঝে-মধ্যে প্রশাসনের অভিযানে কাটা গাছ উদ্ধার ও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না গাছ পাচারের এই মহোৎসব। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে গাছ পাচাররোধে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন তারা।
জানা যায়, রেমা-কালেঙ্গা একটি শুকনো ও চিরহরিৎ বন। যা সুন্দরবনের পর বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রাকৃতিক বনভূমি। ১৭৯৫.৫৪ হেক্টর আয়তনের এই বনভূমিটি হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত। বণ্যপ্রাণীর পাশাপাশি এখানে রয়েছে সেগুন, মেহগনি, আকাশিসহ বিভিন্ন প্রজাতির মূল্যবান গাছ। কিন্তু প্রতিনিয়ত সেখান থেকে গাছ পাচারের কারণে একদিকে যেমন বিরাণভূমিতে পরিণত হচ্ছে বৃহত্তম এই বনাঞ্চলটি তেমনি নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্যও। আর আবাসন হারিয়ে বিলুপ্ত হতে চলেছে বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী।
সম্প্রতি সরেজমিনে বনের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, বনভূমি থেকে গাছ কেটে ট্রাক্টর বোঝাই করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও বনের ভেতর থেকে গাছ এনে ট্রাক কা ট্রাক্টরে লোড করা হচ্ছে। তবে তাদের দাবি, তারা গাছ কাটলেও পাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত না। দারা মাত্র ৪শ’ টাকা মজুরিতে শ্রমিক হিসেবে গাছ কাটেন।
বনের আরও ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, কাটা গাছের শত শত গুড়ি বনের ভেতরে রয়েছে। চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে গাছের ছোট-ছোট ডালপালাও। বেশ কয়েক স্থানে অনেকটা দাপটের সঙ্গে গাছ কাটছেন বনদস্যুরা। সাংবাদিক দেখে অনেকে দৌঁড়ে পালিয়ে গেলেও কেউ কেউ আবার বীরদর্পে গাছ কাটা অব্যাহত রাখেন। এমনকি গাছ কাটার দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করলেও বিষয়টি যেন তাদের গায়েই লাগেনি।
গাছ কেন কাটছেন, তা জানতে চাইলে অনেকে কথা বলতে রাজি হননি। আবার কেউ কেউ দাবি করেন- সরকারি বনাঞ্চল থেকে নয়, নিজেদের খাস জমি থেকে এসব গাছ কাটা হচ্ছে। তারা বলেন- রেমা-কালেঙ্গা থেকে দিনের বেলা কোনো গাছ কাটা হয় না। বনদস্যুরা রাতের আঁধারে বড় বড় গাছ কেটে নেয়।
এদিকে, স্থানীয়দের দাবি, প্রতিনিয়ত চলে এই বনাঞ্চল থেকে গাছ কাটার মচ্ছব। বিশেষ করে সেগুন, মেহগুনি ও আকাশি গাছের প্রতি বেশি নজর বনদস্যুদের। বনাঞ্চলে থাকা এসব মহা মুল্যবান গাছ এখন অধিকাংশই নিধন হয়ে গেছে। বনদস্যুদের সর্বাত্মক সহায়তা করে থাকে বন বিভাগের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দীর্ঘ ৩০ বছরেরও অধিক সময় ধরে এই বনাঞ্চল থেকে গাছ কাটা হচ্ছে। এক সময় এই বনে ৫শ’ প্রজাতির গাছ থাকলেও অব্যাহতভাবে নিধনের কারণে এখন অনেক প্রজাতির গাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
মূলত বন থেকে সিন্ডিকটের মাধ্যমে গাছ কাটা হয়। এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা হলো- নুহ বাহিনীর প্রধান নুহ, হোসেন বাহিনীর প্রধান হোসেন ও মনা মিয়াসহ স্থানীয় একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি। বনের অংশ ভাগ করে বন থেকে গাছ কাটার চক্রকে তারাই নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক গাছ পাচারের মামলাও রয়েছে চুনারুঘাট থানায়। অনেকবার জেলও কেটেছেন তারা। এখনও অনেকে গাছ পাচার মামলায় কারাগারে রয়েছেন। তবে বন্ধ থাকেনি বন থেকে গাছ পাচারের মহোৎসব। তাদের সাঙ্গ-পাঙ্গরা নিয়ন্ত্রণ করছেন চক্রগুলোকে।
আহমেদ আলী নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন- ‘রেমা-কালেঙ্গা থেকে দিনে-দুপুরে গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে পাচারকারীরা। অথচ বন বিভাগের লোকজন নির্বিকার। মাঝেমধ্যে ছোট-খাট পাচারকারীর বিরুদ্ধে মামলা দিলেও অধিকাংশ পাচারকারীই বুক ফুলিয়ে বন থেকে গাছ পাচার করছেন।’
রেমা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাছিমা আক্তার বলেন- ‘দীর্ঘদিন ধরে এই স্কুলে শিক্ষকতা করছি। স্কুলে আসা যাওয়ার পথে প্রায়ই ট্রাক অথবা ট্রাক্টরে করে প্রকাশ্যে গাছ কেটে নিয়ে যেতে দেখি। এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই রেমার প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে। ফলে বন্যাপ্রাণী কমে যাচ্ছে। যা আগামী প্রজন্মের জন্য হুমকিস্বরূপ।’
গাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম বলেন, ‘পূর্বে রেমা-কালেঙ্গা বন বিট থেকে প্রচুর পরিমাণে গাছ কাটা হয়েছে। বলতে গেলে এখন আর তেমন গাছ-পালা নাই। অবশিষ্ট যা আছে, সেগুলো এখন কাটছে পাচারকারীরা। এগুলো বন্ধে প্রশাসনকে আরও সতর্ক হতে হবে।’
রেমা-কালেঙ্গা বন বিটের রেঞ্জ অফিসার মো. আলাউদ্দিন বলেন- ‘আমি এই বিটে যোগদানের পর থেকে অনেক অভিযান পরিচালনা করেছি। বনদস্যু নুহ ও হোসেনসহ একাধিক দস্যুদের আটক করে আইনের আওতায় এনেছি। তারা বর্তমানে জেল-হাজতে রয়েছেন। এছাড়াও এই বন থেকে কোনো গাছ পাচার হয় না। আমরা সার্বক্ষণিক বনের চারপাশ নিয়মিত টহলসহ পর্যবেক্ষণ করছি।’
চুনারুঘাট বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক মো. মারুফ হোসেন বলেন- ‘আমি এই এলাকায় নতুন এসেছি। বন থেকে গাছ পাচার হওয়ার বিষয়টি জানা নেই। তবে বেশ কিছু মামলা রয়েছে। আগামীতে আমরা আরও সতর্ক থাকবো।’
এদিকে, অনেক পাচারকারীর দাবি, সরকারি বনভূমি থেকে নয়, তারা নিজেদের খাস জায়গা থেকে গাছ কাটছেন। তবে সরকারি নিয়ম অনুযায়ি সরকারি খাস জায়গা থেকে গাছ কাটলেও জেলা বা উপজেলা প্রশাসন থেকে অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে অনুমতি নিয়েছেন কি না এ বিষয়ে জানতে চাইলে চুনারুঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বলেন- ‘আমাদের কাছ থেকে কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি।’
তবে এ প্রসঙ্গে খুব বেশি কথা বলতে রাজি হননি তিনি।