প্রায় সাড়ে তিন মাস অতিবাহিত হলেও রেলমন্ত্রীর ঘোষিত এক লাখ টাকা এখনও পায়নি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারগুলো। এ অবস্থায় অর্থ সংকটে হতাহতের অনেক পরিবারই মানবেতর জীবন-যাপন করছে। শুধু তাই নয়, আদৌ অনুদানের টাকা পাবেন কি-না তা নিয়েও তাদের মনে দেখা দিয়েছে সংশয়।
জানা যায়, গত বছরের ১২ নভেম্বর ভোররাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার মন্দবাগ স্টেশনের রেল ক্রসিংয়ে ‘উদয়ন এক্সপ্রেস’ ও ‘তূর্ণা নিশীতা ট্রেনে’র মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ ঘটে। এতে নারী-শিশুসহ ১৬ জন নিহত ও প্রায় শতাধিক যাত্রী আহত হন। নিহতদের মধ্যে ছিল হবিগঞ্জের নয়জন। দুর্ঘটনার পরদিন সকালে পরিদর্শনে এসে নিহতের প্রত্যেক পরিবারকে এক লাখ টাকা সরকারি অনুদানের ঘোষণা দেন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। কিন্তু ঘটনার প্রায় সাড়ে তিন মাস অতিবাহিত হলেও মন্ত্রীর ঘোষিত সেই অনুদাদের টাকা এখনও পায়নি নিহতদের পরিবার। এ অবস্থায় বানিয়াচংয়ের নিহত আল আমীন ও আদিবা আক্তারের পরিবারসহ অনেক পরিবারই অর্থ সংঙ্কটে মানবেতর জীবন-যাপন করছে।
এছাড়াও ওই দুর্ঘটনায় আহতদের পরিবারগুলোর অবস্থা আরও নাজুক। একই পরিবারের একাধিক উপার্জনক্ষম ব্যক্তি পঙ্গু হয়ে ঘরে বসে থাকায় পরিবারগুলোতে দেখা দিয়েছে চরম অর্থ সংকট। ফলে একদিকে যেমন খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে তাদের, অপরদিকে নিতে পারছেন না উন্নত চিকিৎসা। এ অবস্থায় আহতদের অনেকই চিরদিনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণের দিকে ধাবিত হচ্ছেন। কেউ কেউ আবার ধার-দেনা করে টাকা এনে চিকিৎসার ব্যয়বহন করছেন। ফলে বাড়ছে ঋণের বোঝা।
এ বিষয়ে বানিয়াচং উপজেলার গুণই গ্রামের নিহত আল আমীনের স্ত্রী ফুলবানু বলেন, ‘আমার স্বামী পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি ছিলেন। তার রোজগারের আয় দিয়েই চলতো আমাদের সংসার। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে তিন শিশুসন্তান নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছি।’
তিনি বলেন, ‘ঘটনার পর হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৫ হাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা দেয়া হয়েছিল। এছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে কিছু মানুষ যৎসামান্য সহযোগিতা করেছেন। ওই টাকা দিয়ে আমার মাতৃত্বজনিত রোগের চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহ করেছি। বর্তমানে খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করছি। কেউ আমাদের কোন খোঁজ-খবর দিচ্ছে না। শুনেছি মন্ত্রী মহোদয় এক লাখ টাকা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু সে টাকা আমরা এখনও পাইনি।’
একই উপজেলার টাম্বুলিটুলা মহল্লার সোহেল মিয়ার দুই বছরের মেয়ে আদিবা আক্তার দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। এছাড়া গুরুতর আহত হয়ে ঘরবন্দী হয়ে আছেন তিনি ও তার স্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘সাড়ে তিনমাস ধরে কোন কাজ করতে না পারায় পরিবারের অভাব অনটন বেড়েই চলেছে। তাছাড়া টাকার অভাবে আমি ও আমার স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে পারছি না।’
জানতে চাইলে বানিয়াচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মামুন খন্দকার বলেন, ‘ঘটনার পরপরই বানিয়াচংয়ের নিহতদের পরিবারের যাবতীয় কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট দফতরে প্রেরণ করেছি। তবে এখনও এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের কিছুই জানানো হয়নি।’
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, ‘কিছুদিন পূর্বে মন্ত্রণালয় থেকে আমাকে টেলিফোনে জানানো হয়েছিল নিহতদের পরিবারের লোকজনকে ঢাকায় নিয়ে অনুষ্ঠানিকভাবে সরকারির অনুদানের এক লাখ টাকা দেয়া হবে। এ লক্ষে দিন-তারিখও নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে অনিবার্য কারণবশত অনুষ্ঠানটি স্থগিত হয়ে যায়। তবে আমি আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি অনুষ্ঠানিকভাবে অনুদানের টাকা নিহতদের পরিবারের হাতে তুলে দেয়া হবে।
উল্লেখ্য, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার মন্দবাগ স্টেশনের রেল ক্রসিংয়ে উদয়ন এক্সপ্রেস ও তূর্ণা নিশীতা ট্রেনের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনায় হবিগঞ্জের নারী-শিশুসহ নয়জন নিহত হন ও ২৫ জন আহত হন।
নিহতরা হলেন- হবিগঞ্জ শহরতলীর আনোয়ারপুর গ্রামের মৃত হাসান আলীর ছেলে জেলা ছাত্রদলের সহ-সভাপতি আলী মো. ইউসুফ (৩২), বানিয়াচং উপজেলার মদন মোরাদ গ্রামের আইয়ুব আলীর ছেলে আল আমিন (৩৪), একই উপজেলার টাম্বুলিটুলা মহল্লার সোহেল মিয়ার মেয়ে আদিবা আক্তার (২), হবিগঞ্জ শহরতলীর বহুলা গ্রামের আলমগীর মিয়ার ছেলে ইয়াসিন মিয়া (১২), চুনারুঘাট উপজেলার পীরেরগাও গ্রামের মৃত আব্দুল হাশেমের ছেলে ও হবিগঞ্জ সরকারী বৃন্দাবন কলেজের ছাত্র আশিকুর রহমান সুজন (২৫), একই উপজেলার উলুকান্দি গ্রামের ফরিদ মিয়ার ছেলে রুবেল মিয়া (২২), চুনারুঘাট উপজেলার আমরোড এলাকার বাসিন্দা আব্দুস সালামের স্ত্রী পিয়ারা বেগম (৬২), নবীগঞ্জ উপজেলার বনগাও গ্রামের হারুণ মিয়ার ছেলে নজরুল ইসলাম (২৬) ও হবিগঞ্জ সদর উপজেলার সৈয়দাবাদ গ্রামের আজমত উল্লার ছেলে রিপন মিয়া (২৬)।